পাতা ঝরার সমীপে
- Hashtag Kalakar
- Apr 26, 2023
- 7 min read
By Kollorob
দুই গাছের ফাঁক দিয়ে চোখ যেতেই, সূর্যাস্তের রঙীন আভায় ছলছলিয়ে ওঠে মনের ভিতর। জানালার শিকগুলো যেন অজান্তেই চেপে ধরে সেই উত্তেজনা জানালো অপূর্বতার। দিগন্তে, প্রান্তরে প্রাণলেশ সূর্য আভায় সবুজ যেমন মুখ ধুয়ে নেয় অন্তিমতায়, সেই রকমই যেন মনে গাঁথা প্রতিচ্ছবি।
বরাবর সূর্যাস্তটা মন কাড়ে তার। আজ যেন সূর্য দুই গাছের মধ্যে দিয়ে এক অবয়বের রচনা করেছে। কপালে তার সিঁদুরে রাঙা টিপ। মনটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল তার। তার উপর একটি কৃষ্ণচূড়া আর একটি রাধাচূড়া। যা মিষ্টি লাগছে দুইজনকে। আবার কি সুন্দর গলাগলি করে সেজে আছে ফুলে!
"ইস! জানালাটা যদি একটু বড় হলে, বেশ ভালো হত!"
–"নাঃ, যা আছে তাই ভালো-বরং পা উঁচিয়ে আর একটু, ভালো করে দেখেনি!"– মনে হতেই; এক টুকরো কালো মেঘ কোথা থেকে এসে সূর্যের মুখ হঠাৎ ঢেকে দিল!
"এই যাঃ, আর হয়তো দেখা হবে না, আজ সূর্যাস্ত!"
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও আর সূর্যের মুখ ঠিক চোখে পড়ল না।
জানালার প্রান্তে দাঁড়ানো উৎসুক মুখটি লাল আভায় বাইরের অন্ধকারে সাথে মিশে গেল। শুধু অনুভব করা গেল। স্থির চোখ দুটো বাইরে এখনো অপেক্ষায়–শুধু আধখানা সূর্য, তার থেকে অর্ধেক, তার থেকে আরো ছোট হয়ে মিলিয়ে গেল প্রত্যাশার আড়ালে। "কেন যে মেঘ এলো!"–বোঝানো গেল না মনটাকে।
এ এক অদ্ভুত চাওয়া প্রতিদিনের–চলে যাওয়ার আনন্দে যেন চোখে জল আসা–'না! এ এক প্রশ্ন, আবার আসবে তো!'
আলো আবীর খেলায় সূর্যাস্তের এই পড়ন্ত মূহুর্ত এক দিগন্তের সৃষ্টি করে কিশোরীর মনে। চালের ঘরের প্রান্তে এক স্বপ্নময় চোখ বরাবর ওই জানালাটার ফাঁকে মুখ গুঁজে বসে থাকে – একটু সময় পেলেই। সূর্যের সাথে তার এইসময় যেন ভাব জমে ওঠে। ভাব মানে! – গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব বা পরম পাওয়ার কিছু ও চাওয়ার মূহুর্ত। সেই কারণে হয়তো–
"তুমি ডুবে গেলে–
কৃত্রিমতা মোড়া আলো রোস্নাই;
তিমিরে ডোবা মনের ত্রাস।
আঁধারে হারানো নিজ অবয়ব,
উচ্ছ্বসিত চাহিদার আশ;
আলো ছায়া ঘিরে!"
দিনমজুরের ঘর– সাধ ছিল খুব এক বেটি হবে তার, মানে সুবলের! বাপ-দাদারা আগ বাড়িয়ে জানিয়েছিল–"এ বাজারে বেটির থেকে বেটাই বেশি লাভের, বুঝলি!"
কিন্তু নির্বিবাদে মন মেয়েই চেয়েছিল। ছোট্ট দালানে মাইয়াটির দৌড়াদৌড়ি বেশ মন কাড়ে সুবলের। মাঝে মাঝে বৌটা দু-চার ঘা দেয় বটে–কিন্তু সুবল তার মুখের হাসি মিটতে দেখেনি কখনো! কিন্তু আজ যখন তার বিয়ে দেওয়ার কথা মনে আসে–তখনই মনটা কেমন ছলাৎ করে ওঠে। ছোট্ট হরোটা বেশ মন কাড়া হলেও, ওই ছেমরিটা যেন প্রাণ ভ্রমরা! কখন যে ছোট্ট বাবা ডাকা মুখটা বিয়ের যোগ্গি হলো টেরই পায় নি। রোজ সাঁঝে ঘর ফিরতেই দৌড়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরে আবদারের হাত পাতাটা–আজও সুবলকে সারাদিনের ক্লান্তি ও দুর্ভাবনা থেকে যেন এক নিমেষে চাঙ্গা করে তোলে। তার যেন তাকে নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে। কোলে তুলে নিয়ে বলতে ইচ্ছে করে–"মা! এই বাপের কাছে সবসময় থাকবি তো! ছেড়ে পালাবি না তো!"
ভাবতে ভাবতে চোখে জল আসে সুবলের। "মরদের চোখে জল মানায় না,মেয়ের একটা হিল্লে করো, ও আর খুকিটি নেই!"– মহিমার ঝাঁঝালো শব্দগুলো মাথায় বাজ ফেললে, অনেক সময়,দাওয়া থেকে নেমে উঠানের শেষের খোলা মাঠটির দিকে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, মুখে 'রা কাটে না। তবে জ্যোৎস্না রাতেও নরম মনটা কথায় ঝাঁঝরা হয়ে চোখে অমবস্যা নামলে,কখনও, সরলা পিছন থেকে এসে হাতের ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে বলে–"মান হয়েছে! মায়ের কথায়, বেশ আমি যাব না, তোমায় ছেড়ে–হলো তো!"
খুশির রোল পড়ে বাপ বেটির মুখে চোখে। জ্যোৎস্না বা অমাবস্যা যাই হোক, যেন মুখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে খুশির চাওনিতে!
মেয়েকে স্কুলে পড়াবার ইচ্ছে খুব সুবলের। কিন্তু সংসারের অনটন, মহিমার বিরোধে সে আশা আর পূরণ হবার নয়। তারপর হরো আসাতে বাঁধ সাধলো আরো! তবে সরলার হিসেবী বুদ্ধি দেখে মাঝে মাঝে চমকে উঠে বলে–"এ তুই শিখছি কোত্থেকে!"
উত্তরে পায়–"ছোট থেকে পয়সা হাতে দিয়ে গুনতে বলতে,ভুলে গেলে নাকি!"
"না রে মা! ভুলিনি। শুধু একটু জানতে চাইলাম!"– বলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সোহাগ দেখানোকে, মাঝে মাঝেই বাহাল্লামি বলে মনে হয় মহিমার।
মহিমার একটু বেশি দেমাক। সংসারের এই পরিস্থিতি হওয়াকে সে সুবলের বোকামি মানে। 'মেয়ে হওয়ার
আনন্দে এতো মসগুল না হলে,আজ তার দোকানটা বেহাত হতো না'–এটাই মহিমার ধারণা।
কিন্তু সাজানো ফলের দোকানটা যে সরলার আসাতে নয়– বরং ভরসা ছেড়ে দেওয়া তার মদ্যপ ভায়ের চক্রান্তে গেছে, মানে সরলার মামার ক্যাচলামোতে– সেটা সুবল মুখ ফুটে মহিমাকে বলেনি কখনও।
এই মেয়ের জন্মের পর, নিজের পরিবার ও মহিমার ঘর থেকেও কানাকড়ি সাহায্য পায়নি, সেই দুঃসময়ে। গ্রামের ও জানাশোনা বহু লোক কাজ দেবার মানে শুধু পায়ে ঠেলেছে আর বেগার খাটিয়েছে। ফলে সঞ্চিত অর্থ আজ তলানিতে। তবুও হার মানে নি সুবল। সৎ ও সহজ মানুষ হিসাবে থাকার দৃঢ় পণ, তাকে সংসারের অবস্থার উন্নতি না করতে দিলেও, ভাতের অভাব পড়তে দেয়নি। সাথে সরলার প্রতিদিন দু'চার পয়সা প্রাপ্তিতেও টান পড়ে নি।
মহিমার চাহিদাতে আজও সেরকম ভাঁটা পড়ে নি। ঠিকমতো মানিয়ে নেওয়া তার অভ্যেস নেই। পাছে সুবল মেয়ের জন্য কিছু সাজগোজের জিনিস আনলে মহিমা কেড়ে নেয়, তাই বলে দুজনের জন্য জিনিস কেনে সুবল। পারলে মহিমাকে দামিটা দেয়। কিন্তু তাতে কি!–মেয়ের টোল পড়া খুশির হাসিতে সুবলের মন ভরে যায়, নতুন করে বল পায়।
রেলের বাবুরা এবার পূজার আগে একটা কাজ দেবে বলেছে। নতুন রেললাইন পাতা হবে, ঠিকেদারি ও দেখভালের কাজ। কাজ শেষে টাকা, খাওয়া দাওয়া দেবে। মাস যাবৎ সময় লাগবে। কিন্তু যাওয়ার আগে হাত খালি সুবলের। সাথে মহিমার মুখ ঝামটা কাজ হাত ছাড়া ও টাকার খোঁটা চলছেই।
আজ কেমন পরিণত সরলাকে পেল সুবল। মহিমার অজান্তে রাখা প্রতিদিনের জমানো টাকার একটা পুটলি বাপের হাতে দিয়ে বলল–"এতে সাত শো সতেরো টাকা আছে। তুমি কিছুটা নিয়ে, বাকিটা মার কাছে দাও। আর ভাই মার চিন্তা করো না, আমি দেখে রাখব!"
খুব ইচ্ছে করছিল বেটিটাকে জড়িয়ে বুকে আগলে ধরে,কিন্তু এখন যে মন শক্ত করার পালা, মোটা টাকা আমদানি হলে তবেই এ বেটি স্কুলে যেতে পারবে। মহিমার মুখ বন্ধ হবে।
মহিমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে, পিছন ফিরে বাকি টাকা পোটলায় বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যান রিক্সার দিকে রওনা দেয় সুবল। পিছন থেকে দৌড়ে আসে কাপড়ের পোঁটলা নিয়ে সরলা, কোলে হরো! "মুড়ি আর চানাচুর বাতাসা আছে বাবা, খেও!"
'মরদ মানুষের চোখে জল কিসের! ঢং, লজ্জা করে না!'–সত্যি কি লজ্জা করা উচিত!
দুই গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হরো কোলে সরলা, দূর পর্যন্ত ভ্যান রিক্সাকে মিলিয়ে যেতে দেখল। টসটস করে চোখ ভর্তি জলের ফোঁটায় কখন যে আজ পড়ন্ত সূর্য সরলার মাথার উপর থেকে দিগন্তে লাল আভা ছড়িয়ে কালো পর্দা টেনেছে খেয়ালই করেনি, অমাবস্যার রাতটা যেন আরো কালো থেকে ঘন ভারি কালো হয়ে এলো।
সরলার বড্ড চাপা স্বভাবে চেপে বসল ঘরের সব কাজের দায়িত্ব। মহিমার পাড়া বেড়ানো ও গালগল্প করার স্বভাব চিরকালের। আর এখন পতিদেবতার না থাকাতে, মেয়ের কচি ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপিয়ে, পায়ে পা তুলে জমানো টাকায় পান চিবোচ্ছে আর দুনিয়ার গালগল্প করে পাড়া চড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
এদিকে সরলার কদিন আর সূর্যাস্ত দেখা হলো না। মুদিখানা, হরোকে দেখভাল, রান্নার জোগাড়, কাপড় কাচা, জল তোলা সব মিলিয়ে দম ফেলার সময় নেই। তারপর তো তুলসী তলায় সাঁঝ না পড়লে, মহিমার চুলের গোছা ধরে শাসন আর মুখ ঝামটা!
সেদিন সরলা তুলসী তলায় সাঁঝ দেখাচ্ছে আর জল ঝরিয়ে শাঁখে প্রথম ফুঁ দিয়েছে, অমনি–
"সুবল, ও সুবল! ঘরে আছিস!"–ডাক শুনে তাকিয়ে দেখে করিম চাচা। বাইরের কাজ সেরে আজ গ্রামে ফিরেছে বহুদিন পর। "আরে করিম দা যে!–আসুন, তা ফিরলেন কবে!"–মহিমার প্রশ্ন আনকানি করে করিম বলল–"সাঁঝ দেয় কে! ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না!"
"সেকি, আমাদের সরলা গো সরলা!"–করিম চমকে উঠে বলল–"তাই নাকি! এত বড় হয়ে গেছে! তা বেশ,সুবল কোথায়!"
উত্তরে মহিমা নাঁকি কান্না জুড়ে ধাপে ধাপে নিজের ধরনে করিমকে সব জানায়। করিম সব শুনে সেদিন দাওয়া থেকে উঠে পড়ে। সরলাও হাসিমুখে করিম চাচাকে বিদায় জানায়।
শরতে বিস্তৃর্ণ শাল সেগুনের বনে ঝড়ো হাওয়াই উড়ে আসা শুকনো পাতাগুলোর উপর হেঁটে চলার মর্মর শব্দ সরলার মর্মে বাজে। যেন প্রকৃতির নুপুর বাজায় প্রাণের হদিস পায়।
বাবার জন্যে মন কাঁদে তার–ঝরা পাতায় ঝরা কান্না শুকিয়ে যায়, বেশি করে মর্মর আওয়াজ তুলে বাবার কাছে পৌঁছাতে চায়। অনেকদিন হয়ে গেছে–হিসেব করে দেখে সতেরো দিন।
বাবা বলেছিল তিরিশ হলেই সকালে উঠে তাকে দেখতে পাবে। বাকিটা থাকল তেরো দিন, হরোকে নিয়ে শুকনো পাতা পায়ের পাতায় ভাঙতে ভাঙতে হিসাব কোষল সে।
আরে!–তারও তো বয়স তেরো! মানে বাবার আসার বাকি দিন আর তার বয়স সমান! ভারি মজা পেল সে। হরোকে জড়িয়ে ধরে দুই গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শাল সেগুনের বনের মধ্যে সোনালী পাতা ঝরা সূর্যাস্ত দেখল সে। সাথে ঝড়ো বাতাসে আর একটা জিনিসও দেখল। মাঠের বড় পাকুড় গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে করিম চাচা ও মা মাথা নেড়ে কথা বলছে।
পরদিন সকালে উঠে দেখে মা সাত তাড়াতাড়ি উঠান নিকানো,বাসন মাজা, ঘর পোছা করে ফেলেছে। বড্ড দেরি হয়েছে বলে মুখ ধুয়ে রান্নার ঘরে তড়িঘড়ি ঢুকতে যাবে, ওমনি মহিমা পিছন ডেকে বলে–"যা স্নান সেরে চুল আঁচড়ে বস দেখি! করিম চাচা আসবে। চটপট করে নে, আর হরোকেও চুল আঁচড়ে দিস।"
বাড়িতে কেউ আসার খবর শুনলে সরলা খুশি হয়, তাই মার কথা মতো সব চটপট সেরে, রান্নাঘরে মাকে সাথ দিতে ঢুকল। 'মাকে যেন আজ অন্যরকম লাগছে,আসতেই তার গলার চেনটা পড়িয়ে দিল, কড়ি আঙুল দাঁত দিয়ে কেটে নজর কাটল!'–সরলা সব দেখে চুপ করে থাকল। চাপা মনের তো! কিন্তু চাপা হিসাবে যে আরো বারো দিন বাকি!
সময় মতো করিম চাচা আর সাথে একজন শহর বাবুকে আসতে দেখল। তারা আসতেই মা দৌড়ে গেল, কথা শুনল আর মাথা নাড়াল। সেদিন হরোকে কোলে নিয়ে, জানালা দিয়ে সরলা সূর্যাস্ত খুব মন দিয়ে দেখেছিল। হরো কোল থেকে নামার জেদে তাকে গালে চড় মারলেও তার চোখ সরেনি, শুধু চোখে ছলছল জলের রাঙা কাজল রেখা আঁকা ছিল।
রাতের বেলা খেতে বসে, মার করিম চাচার ডাকে এঁটো হাতে বাইরে দৌড়ে যাওয়া দেখে, অবাক হলেও কিছু বলেনি। গুনে ছিল আর বারো দিন।
সকালে উঠে মার কথাগুলো শুনে হরো বুক আঁকড়ে কেঁদেছিল। "দিদি তুই কাঁদচ্ছিস"–আদো কথায় আরো কেঁদেছিল। আর গুনে ছিল এগারো!
পরদিন নতুন কাপড় আর সাজার জিনিস দেখে সরলার মন পাথর হয়ে যায়। চুপ থেকে গুনল দশদিন।
পরদিন দুপুর বেলা করিম চাচা আবার সেই লোক নিয়ে এলো। দেখল মা শাড়ির কোঁচলে করিম চাচার হাত থেকে কিছু লুকিয়ে নিয়ে গিঁট মারল। বিকেলে জানালার শিকে মুখ এঁটে পড়ন্ত সূর্যকে বলেছিল ন'দিন।
মহালয়ার ঠিক আগের ভোর বেলা:
"সরলা, ও মা সরলা! কোথায় তুই!"–ডাক ভেসে আসতেই মহিমা ধড়পড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে দেখে সুবল হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাজির। সরলা এক দৌড়ে দাওয়া থেকে দালানে লাফিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগল। তার কান্না দেখে সুবল বাজার ব্যাগ ফেলে কড়া সুরে জিজ্ঞেস করল–"কি হয়েছে বৌ! মেয়ে কাঁদে কেন?"
মহিমার জড়িয়ে ভাব দেখে সুবল তাকে এক টানে দাওয়া থেকে দালানে আনতেই তার কোঁচলের গিঁট খুলে পড়ল এক তারা নোটের বান্ডিল।
"বৌ!"–বলে গায়ে হাত তুলতে যাবে, এমন সময়– "মহিমা, ও মহিমা! উঠেছো নাকি!"–করিমের গলা পেয়ে বাবা মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বলল–"সাতসকালে করিম যে! তা কি মনে করে!" করিম ও তার বাবু দালানে পা রাখতেই সুবলের গলা পেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে গেল। সুবল নোটের বাণ্ডিল তুলে করিমের হাতে দিয়ে বলল–"বাইরে কাজ করতে যাওয়ার নমুনা কি করিম! শোন মেয়েদের সম্মান করতে সবাই পারে নে, আর সন্তান তো খোদার দান, নয় করিম!"
করিমের বাবু কিছু বলতে গেলে সুবল রক্ত চক্ষু হয়ে বলে–"তুমি এবার এসো করিম!"
মহিমা সুবলের পায়ে এসে নাকি কান্না জুড়লে সুবল সরে গিয়ে বলে–"আমি আমির সরলা মাকে স্কুলে ভর্তি করব। আমি সর্বনাশের খবর পেয়ে,রেলবাবুদের কাছে একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি, সরলাকে সঙ্গে করে নিতে যেতে। তোর কোন আর বাহানা শুনব না, বৌ!"
এই প্রথম সুবলের তেজি চেহারায় মহিমা সিঁটিয়ে গেল। দুপুর বেলা সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে দিল ঘুম। রান্না বাবা মেয়ে করেছিল। আর দুই ভাইবোন ঘুমিয়ে ছিল বাবার বুকে। বিকেলে জানালা দিতে সরলাকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখে, সুবল তার পাগলী মেয়ে ও ছেলেকে কোলে নিয়ে এসে দাঁড়াল দুই গাছের মাঝখানে। তাতে পড়ন্ত বেলায় যে অবয়বটা মহিমা দেখেছিল তাতে তার ধারণা কতটা বদলেছিল, জানা নেই। কিন্তু, ঝড়ো হাওয়াই উড়ে আসা শুকনো পাতাতে পড়া আভা,যেন এক মায়াময়ী দেবীর ঘোমটা খোলা ললাট রেখায় সিঁদুরে টিপটা পরিয়ে দিয়েছিল।
By Kollorob

Comments