top of page

সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি : 'গোয়েন্দা' গল্প বনাম গোয়েন্দা 'গল্প'

By Anshuman Roy


           অংশুমান রায় (গবেষক, স্বামী বিবেকানন্দ রিসার্চ সেন্টার, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির)  

অতীত ইতিহাসের অস্তরবিচ্ছটায় যতটা না থাকে আলোক প্রত্যাশা, তার থেকেও বেশি ভীড় করে আসে স্মৃতিমেদুরতা। আলোকোজ্জ্বল বর্তমান ও অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যতের থেকেও নিঃশব্দ পদপাতে পিছনপানে টানে অতীতের সব দায়ভার। একবিংশ শতাব্দীর এই টেক-স্যাভি যুগেও তাই বিংশ শতাব্দীর অনিমেষ স্মৃতিচারণ বয়ে আনে অসংখ্য টুকরো স্মৃতির বর্ণময় কোলাজ। আসলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের ত্রিধারা সম্মিলনীতে যেমন ক্রমশই ফিকে হয়ে গিয়েছিল পূর্ববর্তী শক্তিশালী মহাকাব্যিক রথঘর্ঘর, তেমনি ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাপুরুষদের চেতনালব্ধ ‘নৈষ্কর্ম্যসাধনার সত্যানুসন্ধান’ কল্লোল-কলরব নিয়ে আবির্ভূত বিংশ শতাব্দীর দোসর হয়ে ধীরে ধীরে পরিণত হল আপামর বাঙালির জীবনানুসন্ধানে। বিশ শতকের সূচনায় বাঙালি সমাজের এক বিরাট অংশ স্বদেশীমন্ত্রে হয়ে উঠেছিল উজ্জীবিত। অত্যাচারীর দাসত্বশৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবার বাসনায় ফাঁসির মঞ্চে অকাতরে আত্মাহুতি দিতে এগিয়ে আসছিলেন একের পর এক বাঙালি তরুণ। রুশবিপ্লবের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আবার কেউ শোষণমুক্ত শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার স্বপ্নও লালন করছিলেন সযত্নে। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বাংলার কৃষক সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিলেন-

‘ হেই সামালো ধান হো

                          কাস্তেটা দাও শান হো

                          জান কবুল আর মান কবুল

                          আর দেবনা আর দেবনা 

                          রক্তে বোনা ধান, মোদের প্রাণ হো’।

দাবী উঠেছিল- ‘আধি নয়, তেভাগা চাই’। নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে জোট বেঁধেছিলেন বাংলার শ্রমিককুল। আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর রেশ সেদিন স্পন্দন তুলেছিল বাঙালির শিরায় শিরায়। এরপর একে একে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, সুভাষের প্রতিশ্রুতি, পঞ্চাশের মন্বন্তর, দেশভাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা, স্বাধীনতাত্তোর কালে অর্থনৈতিক মন্দা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা, মূল্যবোধে ভাঙন, রাজনৈতিক দিশাহীনতা প্রভৃতি বাঙালির মানসলোকে তৈরি করেছিল বিক্ষুব্ধ তরঙ্গস্রোত। নিয়ত পরিবর্তমান এই বাঙালি সমাজের ছবিই ক্রমাণ্বয়ে ফুটে উঠেছিল তদানীন্তন বাংলা সংবাদপত্রে, চলচ্চিত্রে, গানে, গল্প-উপন্যাস-নাটকে।

বহুশ্রুত প্রবাদ সমৃদ্ধ করে আমাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে, জানায় যে নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। তেমনি বিক্ষুব্ধ সমকালের এই ঘটনাস্রোত ছাপ ফেলেছিল বাঙালির সাহিত্যসাধনাতেও। পরিবর্তনশীলতার ঘূর্ণাবর্তে ধীরে ধীরে পাল্টায় সবই – বাঙালির ভাষা, আচার-আচরণ, ধর্মকর্ম, প্রেক্ষিত ও প্রতিবেশ সব। শুধু পাল্টায়না বাঙালি নারীর বৃহদংশের সীমাহীন বঞ্চনার সামাজিক ইতিহাস। অবশ্য শুধু বাংলায় কেন, সমগ্র বিশ্বে নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের সামগ্রিক ছবিটাতেও খুব বেশি পার্থক্য চোখে পড়েনা। ১৭৯২ এ প্রকাশিত মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের লেখা ‘ দি ভিন্ডিকেশান অফ দি রাইটস্‌ অফ ওম্যান’ এর যে সুর, তার ১৫৭ বছর  পরে ১৯৪৯এ প্রকাশিত সিমন দ্য বোভোয়া’র ১০০০ এরও বেশি পৃষ্ঠার বই ‘ল্য দ্যজিয়ম সেক্স্‌ঃ দ্য সেকেন্ড সেক্স্‌ ঃ দ্বিতীয় লিঙ্গ’ তেও প্রায় একই ধরণের কথাবার্তা আছে, তবে তার আঙ্গিকটা সামান্য আলাদা। নারী যে শুধু ‘তোতা মিউলিয়ের ইন ইউতেরো’(নারী হচ্ছে জরায়ু) নয়, তারই সমর্থনে দীর্ঘতর যুক্তির পারম্পর্যমন্ডিত বক্তব্য তুলে ধরেছেন ব্যক্তিক জীবনে নারীকে কেবলমাত্র প্রজননের, রান্না করার বা বাসন মাজার যন্ত্র হিসাবে মনে করার ঘোরতর পরিপন্থী সিমন দ্য বোভোয়া। আবার ১৯৩১ সালে প্রকাশিত, পূর্ববাংলার পায়রাবন্দ গ্রামে আবির্ভূতা বেগম রোকেয়ার ‘অবরোধবাসিনী’ গ্রন্থে পুরুষকে প্রচণ্ড আক্রমণ, নিন্দা, পরিহাসের পর তিনি বলেছিলেন-

আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাইবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি, নচেৎ কিসের সহিত এ                    উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষের অবস্থাই আমাদের উন্নতির আদর্শ। ২   

অথবা রোকেয়ার চাবুকের মত লেখায় তীব্র আক্রমণাত্মক প্রতিবাদ পরিলক্ষিত হয় পুরুষ শাসিত মুসলিম সমাজে স্ত্রীশিক্ষার প্রতি ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে-

মুসলমানদের যাবতীয় দৈন্য দুর্দশার একমাত্র কারণ স্ত্রীশিক্ষায় ঔদাস্য। ভ্রাতৃগণ মনে করেন, তাঁহারা গোটাকতক আলীগড় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর করিয়া পুলসিরাত (পারলৌকিক সেতুবিশেষ) পার হইবেন- আর পার হইবার সময় স্ত্রী এবং কন্যাকে  হ্যান্ডব্যাগে পুরিয়া লইয়া যাইবেন।৩ 

এমনকি একবিংশ শতকের প্রথমার্ধে প্রাবন্ধিক রুশতী সেন যখন তাঁর ‘বাঙালি মেয়ের হাল বেহাল’ প্রবন্ধটি লেখেন, তখনও তার সূচনায় নারীজাতির শম্বুকগতি অগ্রসরমানতাজনিত বেহালদশার নির্মোক উন্মোচনে নিয়ে আসেন সাহসিকতার জেরে সংবাদপত্রের শিরোনামে আসা জনৈক ‘আলোপতি’ বা ‘তসলিমা’র জীবন সত্যকে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে যেসব মহতী বাঙালি নারী দেশকে করেছেন মহিমাণ্বিত, তাঁদের সূচনায় না আনার কারণ হিসাবে তিনি যুক্তি দিয়েছেন- 

তবে কি আলোপতি অথবা তসলিমার প্রসঙ্গে প্রবন্ধ শুরু করা সঙ্গত হলো না? শতাব্দীর শুরু থেকে বাঙালি নারী যে গৌরবময় ইতিহাস বহন করছে, তার আশ্রয়েই বানিয়ে নিতে হতো এই প্রবন্ধের উপক্রমণিকা? একদিকে একজন স্বর্ণকুমারী দেবীর আলোকিত আগমন, একজন অসামান্য কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের আশ্চর্য মেধা এবং বিস্ময়কর কর্মময়তা, একজন চন্দ্রমুখী বসুর অপার ব্যুৎপত্তি, একজন সরলা দেবীর দৃপ্ত গ্রহণ-বর্জন, অন্যদিকে সরোজিনী নাইডু অথবা অরুণা আসফ আলির রাজনৈতিক জীবনচর্যা, বাসন্তী দেবীর সমাজকল্যাণের ব্রত, শান্তি ঘোষ-সুনীতি চৌধুরী-বীণা দাস-কমলা দাশগুপ্ত-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-কল্পনা দত্তর দুর্জয় সাহস আর মরিয়া আবেগ। এই পরম সমৃদ্ধ গৌরবগাথার উত্তরাধিকার কি কোনোভাবে স্পর্শ করল আলোপতি-তসলিমার দেশ-কাল-সমাজকে? কেমন সেই স্পর্শের স্বরূপ? ওইসব কীর্তিময়ীদের কীর্তিকাহিনী থেকে তাঁদের যথার্থ জীবনকাহিনীতে পৌঁছনোর যে পথ, সে পথের অনিশ্চিতি কতখানি? কেমন দেখতে সেই পথের জটিল বাঁকগুলো? সেই জীবনকাহিনী যদি সত্যিই কোনোদিন নিরাবরণ পড়া যায়, তবে কি সমৃদ্ধি আর গৌরবের চেনা আখ্যান নতুন করে লিখতে হবে? তবে কি অখ্যাতির আড়ালে ঢাকা আঁধার জীবনপ্রবাহের অনেক নিষ্ফল নারীর মুখ, বহু শুভবুদ্ধি-দক্ষতা-সম্ভাবনার অপচয় ফুটে উঠবে কীর্তিময়ীদের সম্মুখবর্তী দর্পণে?                                                                    

প্রথমার্ধের এই গৌরচন্দ্রিকার একটিই লক্ষ্য - বিশ শতকের মহিলা ঔপ্যনাসিক বা গল্প রচয়িতাদের রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটু ওয়াকিবহাল হয়ে নেওয়া। বিশ শতকের বাংলা গল্প-উপন্যাসের ঝাঁপি যাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণে বেশ সম্পন্ন, তাঁরা হলেন- বেগম রোকেয়া, জ্যোতির্ময়ী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, আশাপূর্ণা দেবী, মৈত্রেয়ী দেবী, বাণী রায়, মহাশ্বেতা দেবী, বাণী বসু, নবনীতা দেবসেন, কেতকী কুশারি ডাইসন, কণা বসু মিশ্র, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, জয়া মিত্র, অনিতা অগ্নিহোত্রী, তসলিমা নাসরিন প্রমুখ।

প্রগতিশীল কথাকার সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সাহিত্যবাসরে আত্মপ্রকাশ বিশ শতকের সত্তরের দশকের শেষের দিকে। বিহারের ভাগলপুরে মামারবাড়িতে সুচিত্রা ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ১০ই জানুয়ারি। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে। মূলত পরিণত বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি সাহিত্যরচনায় মনোযোগী হন। বিবাহের কারণে সাময়িক ছেদ পড়ে সাহিত্যচর্চায়। কলকাতার ঢাকুরিয়ায় জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন বলে তাঁর সাহিত্যের অন্যতম উপজীব্য হল শহুরে জীবন ও তার নানা দিক। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের দেখা কলকাতাকে বুঝলে তাঁর লেখার প্রেক্ষাপট বোঝাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে কলকাতার মন্বন্তর, ৪৭এ দেশভাগ উত্তর সময়ে দারিদ্র্য, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রেশ তখনো কাটেনি। তার উপর কলকাতাতে শুরু হওয়া ভারত কাঁপানো ‘নকশালবাড়ি আন্দোলন’এর রেশটুকু তখন কঠোর হাতে দমন করেছে রাষ্ট্র। ফলে রাষ্ট্রে তখনও স্থিতিশীলতা নেই। সামাজিক অবক্ষয় যথেষ্ট গভীর। এমন এক প্রেক্ষাপটে সমকালীন সামাজিক ঘটনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের গল্প গড়ে উঠেছে। শহুরে মধ্যবিত্তদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে নৈতিক অবক্ষয়, যুগের পরিবর্তনশীল নীতিবোধ, নারীজীবনের দুঃখ যন্ত্রণা ও সামাজিক অবস্থান, দাম্পত্য সংকট ও সম্ভাবনা, সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত, নারী পুরুষের প্রেম, বয়স্কদের পারিবারিক ও সামাজিক নানা সমস্যা ইত্যাদি তাঁর কথাসাহিত্যের বিষয়-আশয়। ২০০৪ সালের পর সাহিত্যে পূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলি হল ‘দহন’, ‘কাচের দেওয়াল’, ‘কাছের মানুষ’, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’, ‘গভীর অসুখ’, ‘চার দেওয়াল’, ‘হেমন্তের পাখি’ প্রভৃতি। গল্প সংকলনগুলি হল- ‘অন্য অনুভব’, ‘খাঁচা’, ‘ময়না তদন্ত’ ইত্যাদি। পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ভুবন মোহিনী মেডেল’(২০০৮), দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কাঁথা’, ‘তারকেশ্বর’(২০০০), ‘সাহিত্যসেতু’(২০০৮), বেঙ্গালুরু থেকে ‘নন্‌জাগুড়ু থিরুমালাম্বা’ জাতীয় পুরস্কার, ভাগলপুর থেকে ‘শরৎ পুরস্কার’(২০০৮), এছাড়াও ‘ভারত নির্মাণ অ্যাওয়ার্ড’, ‘দিনেশ্চন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার’(২০১৫) ইত্যাদি। তবে ২০১৫ সালের ১২ই মে রাত ১০.৪৫ মিনিটে হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর চলে যাওয়াটা যেন সত্যিই মেনে ওঠা যায়না।

প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায় ওরফে ‘মিতিনমাসি’ বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের ঘরানায় নিঃসন্দেহে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের এক উল্লেখযোগ্য উপহার। এর আগেও বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো মহিলা লেখিকা বা ঔপন্যাসিকের রচনায় রহস্য উদ্ঘাটনকারী নারীকে (যেমন প্রভাবতী দেবীর ‘কৃষ্ণা’) দেখা গেলেও এতো বিস্তৃত আকারে কোনো নারী গোয়েন্দাকে এই প্রথম বাংলা সাহিত্যে পূর্ণাঙ্গ রূপে দেখা গেল। বিশ শতকের একবারে শেষের দিকে ‘পালাবার পথ নেই’(১৯৯৮) দিয়ে মিতিনমাসির যাত্রা শুরু। প্রতিবছর আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে নিয়মিত প্রকাশিত হওয়া মিতিনমাসির কাণ্ডকারখানায় শিশুমনের জন্য রয়েছে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের চাবিকাঠি, রয়েছে আবিষ্কারের নির্মল আনন্দ। ‘পালাবার পথ নেই’ বড়দের জন্য লেখা হলেও এরপর মিতিনমাসির অভিযানগুলি প্রায় সবই ছোটদের জন্য লিখিত। বাংলা সাহিত্যে মিতিন মাসির বিখ্যাত পূর্বজরা হলেন- ব্যোমকেশ বক্সী (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়), ফেলুদা (সত্যজিত রায়), অর্জুন (সমরেশ মজুমদার), কিরীটী (নীহাররঞ্জন রায়), রবার্ট ব্লেক (দীনেন্দ্রকুমার রায়), পরাশর বর্মা (প্রেমেন্দ্র মিত্র), কিকিরা (বিমল কর), ঋজুদা (বুদ্ধদেব গুহ) প্রমুখ। শুধু বুদ্ধির চাতুর্য বা কৌশলী ক্ষিপ্রতা প্রদর্শনই যে ‘মিতিনমাসি’ চরিত্রটি সৃষ্টির একমাত্র কারণ নয়, তা ‘মিতিনমাসি সমগ্র’, ১ম খণ্ড’র ভূমিকাতেই স্পষ্ট করে দেন লেখিকা নিজেই। শুধু খুনোখুনির কিনারা বা রহস্য রোমাঞ্চে ভরা থ্রিলার নয়, গোয়েন্দার এর সাথেই থাকতে হবে  সহানুভূতি ও রসবোধ। লেখিকা এও চাইতেন যে গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে শিশু-কিশোররা আমাদের দেশ, রাজ্য, পুরানো ইতিহাস, স্থাপত্য, পুরাকীর্তি সম্পর্কে অনেক জ্ঞান আহরণ করবে। এদিক থেকে দেখতে গেলে মিতিনমাসির অভিযানের গল্পগুলি বেশ তথ্যসমৃদ্ধ ও নির্মল জ্ঞানের ভাণ্ডারও বটে। সর্বোপরি গোয়েন্দা মাত্রেই যেখানে পুরুষ চরিত্রের অনিবার্য উপস্থিতি উপলব্ধ হয় আমাদের অন্তঃকরণে, সেখানে সমান্তরাল জন-ভাবনার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র নির্মাণটাই একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে ধরা দেয় লেখিকার কলমে।

প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায় একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ, যার সংস্থার নাম ‘THIRD EYE’। মধ্যত্রিশের এই ভদ্রমহিলার দিদি সহেলির একমাত্র কন্যা ঐন্দ্রিলা ওরফে টুপুরের সে মাসি, সেই সূত্রেই তার নাম মিতিনমাসি। প্রজ্ঞাপারমিতা নামটিও বেশ সতর্কতার পেশার সঙ্গে মানানসই করেই বেছে নিয়েছেন লেখিকা। স্বামীর নাম পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায় ওরফে পার্থমেসো, যার বউবাজার এলাকায় একটি নিজস্ব প্রেস আছে। দুজনের একমাত্র সন্তান বুমবুম, সেন্ট থমাসের প্রাথমিক বিভাগের ছাত্র। ঢাকুরিয়ায় এক ভাড়াবাড়িতে তাদের বসবাস। মিতিনমাসির একটি টুকটুকে লাল রঙের মারুতি আছে, যা প্রয়োজনে সে বা তার স্বামী ড্রাইভ করে। টুপুরের বাড়ি উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে। বাবা অবনীবাবু কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক, মা গৃহকর্ত্রী। মিতিনমাসি চরিত্রটি যেহেতু বাঙালি গৃহের অন্যতম চালিকাশক্তি আবার বুদ্ধিবণিকও বটে, তাই তার চরিত্রে একটা দ্বৈতসত্তার মিশেল দেখতে পাওয়া যায়। পার্থমেসো বাঙালি ভদ্রলোকের ছাঁচে গঠিত একটি চরিত্র যে আদ্যন্ত উদরপরায়ণ, শব্দছক সমাধানপ্রিয়, পত্নীনিষ্ঠ ও পারিবারিক এক মানুষ। মিতিনমাসি কেবলমাত্র গোয়েন্দা নয়, সংসারের সব দিকেই তার নিপুণ লক্ষ্য, তা সে বুমবুমের পড়াশোনা, টুপুরের হোমওয়ার্ক বা কাজের মেয়ে ভারতীকে সাহায্য করা যাইহোক না কেন। দীর্ঘ অবকাশ যেমন গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতে টুপুর যখন মাসির কাছে থাকতে আসে ছুটি কাটাতে, তখনই অবধারিতভাবে গোয়েন্দা গল্পের চরিত্র মেনে উপস্থিত হয় কোনো না কোনো কেস। মিতিনমাসি তার দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেই ঘুরে যায় নতুন নতুন রহস্যের মোড়। আর প্রায় সব ঘটনারই সঙ্গী ও সহকারী থাকে বোনঝি টুপুর, মাঝেমধ্যে স্বামী পার্থও, কখনো কখনো পুত্র বমবুম।  প্রায় পারিবারিক বন্ধু হয়ে যাওয়া রাজ্য সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের DIG অনিশ্চয় মজুমদার অনেক কেসেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন আবার বিপরীতক্রমে কখনো তিনি মিতিনমাসির সাহায্যপ্রার্থীও বটে।

আয়তনের কথা মাথায় রাখলে মিতিনমাসির সব অভিযানগুলিকে উপন্যাস না বলে অনেকগুলিকে বড়গল্প বলাই শ্রেয়। গল্পগুলি পূজাবার্ষিকীর পরে আনন্দ প্রকাশন থেকে ‘কিশোর কাহিনী সিরিজ’ নাম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য দে’জ থেকে প্রকাশিত ‘তিন মিতিন’(২০০৮) একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ, যাতে তিনটি গল্প একত্রে প্রকাশিত  হয়েছিল – ‘বিষ’, ‘তৃষ্ণা মারা গেছে’  ও ‘মারণ বাতাস’। মিতিনমাসির অন্যান্য অভিযান গুলি হল- ‘সারাণ্ডায় শয়তান’, ‘আরাকিয়েলের হীরে’, ‘গুপ্তধনের গুজব’, ‘ছকটা সুডোকুর’, ‘জার্মান গণেশ’, ‘জোনাথনের বাড়ির ভূত’, ‘ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য’, ‘টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল’, ‘দাবানলের দেশে’, ‘দুঃস্বপ্ন পারাবার’, ‘ভাঙা ডানার পাখি’, ‘মারকুইস স্ট্রীটে মৃত্যুফাঁদ’, ‘সর্পরহস্য সুন্দরবনে’, ‘হাতে মাত্র তিনটি দিন’, ‘স্যাণ্ডর সাহেবের পুঁথি’ ( সর্বশেষ প্রকাশিত- আনন্দমেলা ২০১৫)। 

‘পালাবার পথ নেই’ উপন্যাসে বিদিশার অতীত জীবন ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে অদৃশ্য এক ব্ল্যাকমেলার। এরই মধ্যে ঘটে যায় এক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। শেষে প্রজ্ঞাপারমিতার হস্তক্ষেপে সমাপ্তি ঘটে রহস্যের। দোষী শাস্তি পায় মিতিনের কৌশলী বুদ্ধিতে।

‘গুপ্তধনের গুজব’ উপন্যাসে নুরপুরের (ডায়মণ্ড হারবার, দঃ ২৪ পরগণা) বাসিন্দা কানাডা ফেরত মীনধ্বজ মর্মরবক্ষ বাগচী’র ‘নিন্‌হো’ (পোর্তুগীজ ভাষায় অর্থ ‘পাখির বাসা’) বাড়ি নিয়ে হঠাৎই রটে যায় গুপ্তধনের গুজব। পোর্তুগীজ ব্যবসায়ী বেসিল ডি আলমিডার কাছ থেকে বাগচীদের পূর্বপুরুষ বাড়িটি কিনেছিলেন। ফলে গুপ্তধন থাকা কিছু অসম্ভব নয় মনে করে মাঝে মধ্যেই শুরু হয় হানা, বিভিন্ন উপদ্রব। বাড়ির কাজের মেয়ে করুণা বা কুলপুরোহিত অনঙ্গমোহনের দিকেই ঘোরাঘুরি করতে থাকে সন্দেহের তীর। তবে পরিণামে সবাইকে অবাক করে দিয়ে দোষী প্রমাণিত হয় বাড়ির কেয়ারটেকার আপাতনির্দোষ সন্দীপন, যে কিনা মীনধ্বজ মর্মরবক্ষ বাগচী’র অত্যন্ত বিশ্বাসের পাত্র ছিল। সবার চোখের আড়ালে ভাগিরথীর পাশে অবস্থিত জাহাজবাড়ি ‘নিনহো’র বেসমেণ্ট এ সে অবৈধ অস্ত্রশস্ত্রাদি, কার্তুজ, বন্দুক, বোমা ইত্যাদি পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অবৈধ মজুদ করছিল। যাতে ভুতুড়ে বাড়ির ভয়ে কানাডা ফেরত মীনধ্বজ বাবু বাড়ি ফাঁকা করে দেন, তাই এত আয়োজন। 

‘হাতে মাত্র তিনটি দিন’ উপন্যাসটিতে হঠাৎই নিখোঁজ হয় বিখ্যাত কার্পেট ব্যবসায়ী শেঠ রুস্তমজি জরিওয়ালার একমাত্র পুত্র রণি, যে সেন্ট পিটার্সের ক্লাস ফোরের ছাত্র। অপহরণকারীরা তিনদিন মাত্র সময় দেয় ও এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবী করে। মিতিনের তৎপরতায় ও ক্ষুরধার বুদ্ধিতে তিনদিনের মধ্যেই উদ্ধার হয় রণি। প্রমাণিত হয় শেঠজী’র বিশ্বস্ত পি.এ অশোকবাবুর ভাইকে  বরখাস্ত করেছিলেন শেঠজী, আত্মীয়তার সূত্রে সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে অশোকবাবুই এই কাণ্ডটি ঘটান। এই উপন্যাসটিতে কলকাতার পার্সি সমাজের আচার-আচরণ, ধর্মাচরণ, উৎসব- অনুষ্ঠান, রীতিনীতি সম্পর্কে এক বিস্তারিত তথ্যভাণ্ডার হস্তগত হয় পাঠক সমাজের। 

‘জোনাথনের বাড়ির ভূত’ উপন্যাসটিতে কলকাতার এক প্রথম প্রজন্মের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জোনাথন মাইকেলের ‘মেগ্‌না’ নামক বাড়িতে ‘হোলি স্পিরিট’ এর উপদ্রব শুরু হয়। একটি জনহীন বদ্ধঘরে শুরু হয় ফার্নিচারের নড়াচড়া, প্রচণ্ড শব্দ। আরো বিপত্তি ঘনিয়ে আসে তখন, যখন একে একে ভাঙতে থাকে বাড়ির সমস্ত ফার্নিচারের কাচ, জানালার শার্সি, টিউবলাইট, বাল্ব ইত্যাদি। মিতিনমাসির সন্ধানী চোখ অসীম ধৈর্যের সঙ্গে অনুসন্ধান শুরু করলে উদ্ঘাটিত হয় মূল সত্য। জোনাথন মাইকেলের ‘মেগ্‌না’ বাড়ির সম্পত্তির ভাগ ও প্রচলিত কিংবদন্তী অনুযায়ী বাড়ীর গুপ্তধনের লোভে ছেলে ডিক, মেয়ে জামাই মির্না ও উৎপল ক্রিস্টোফার বিশ্বাস, বহুদইনের বিশ্বস্ত পরিচারিকা মিসেস জোন্‌স সবাই আলাদা আলাদা ভাবে চক্রান্তের ঘুঁটি সাজায়। মিতিনমাসি এই উপন্যাসে কেবল অপরাধীকেই যে শনাক্ত করে তা নয়, বরং সম্পর্কের বন্ধন দুর্বল করে দেওয়া আদিমরিপু কদর্য লোভের স্বরূপটিও উন্মোচিত হয়ে পড়ে প্রবীণ জোনাথনের বহুদর্শী দৃষ্টিপথে। 

‘ঝাও ঝিয়েন হত্যা রহস্য’র মূল কারণ কাপড়ে লেখা একটি প্রাচীন চৈনিক ওয়ালহ্যাঙ্গিং, যেটা আদতে প্রাচীন চৈনিক শিল্পী মো-ই-টং এর আঁকা পৃথিবীর প্রাচীনতম মানচিত্র। টেরিটিবাজারের এক চীনা স্কুলের ভালোমানুষ শিক্ষক-গবেষক ঝাও ঝিয়েনের হাতে এক কিউরিওশপ থেকে আসে সেটি। ইতিহাসে পুনরাবিষ্কারের সাক্ষী হতে চেয়ে এবং মানচিত্রটির বর্তমান মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকায় ইতিহাসের এক নামী অধ্যাপক ও ঝাও ঝিয়েনের একদা সহপাঠী (ন্যাশনাল লাইব্রেরির মেম্বার ছিলেন দুজনেই) তরুণবাবু খুন করেন ঝাও ঝিয়েনকে। মিতিনের রহস্যভেদী বুদ্ধির কাছে হার মানতে হয় বুদ্ধিমান অধ্যাপককেও। আসলে পাপ কখনো চাপা থাকে না।

‘আরাকিয়েলের হীরে’ একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। হাসমিক ভারদোন নামের এক আর্মেনিয়ান ভদ্রমহিলা মিতিনমাসির কাছে এসে বললেন, তার আঙ্কেল জোসেফ আরাকিয়েল মারা যাওয়ার পর তাঁর সিন্দুকের মধ্যে রক্ষিত পাঁচ ক্যারাটের মূল্যবান হীরেটি চুরি গেছে। অতি মূল্যবান এই হীরের মূল্য প্রায় দু’কোটি টাকা। রহস্য ক্রমশ ঘনীভূত হয়। শেষ পর্যন্ত মহা মূল্যবান হীরে উদ্ধার হল কারো হেফাজত থেকে নয়, অ্যাকোরিয়ামের তলার গুপ্ত দেরাজ থেকে। হাসমিকের ভালো মানুষ মুখের আড়ালে দেখা গেল অপরাধীর মুখ, যিনি হীরে চুরি করতে পারেননি বটে, তবে মোমবাতির সঙ্গে মার্কারি মিশিয়ে আঙ্কেল জোসেফের বিধবা স্ত্রী ইসাবেলকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন।

‘ছকটা সুডোকুর’ উপন্যাসে একটি সুডোকুর ছক সমাধানের পুরস্কার হিসাবে সপরিবারে সিঙ্গাপুর যাওয়ার টিকিট পায় পার্থমেসো। সঙ্গে যায় টুপুরও। ‘পেঙ্গুইন রিসর্টস্‌ ইন্টারন্যাশনাল’ নামক ভ্রমণসংস্থার ছদ্মবেশের আড়ালে একটি আন্তর্জাতিক গুপ্তচর সংস্থা ভ্রমণার্থীদের টিকিটের মাধ্যমে ভারতবর্ষের গোপন খবর বিদেশে পাচার করত। সবাই নিঃসন্দেহে থাকলেও সেটা মিতিনের চোখ এড়ায়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত অপরাধীরা সকলেই ধরা পড়ে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একই কাজে নিযুক্ত গোয়েন্দা প্রধান সুজিত বসু বাহবা জানান প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়কে।

‘সর্পরহস্য সুন্দরবনে’ উপন্যাসে আমেরিকা ফেরত বিজ্ঞানী সুমন্ত্র সান্যাল সুন্দরবনের সর্পসঙ্কুল নির্জন বাসন্তী দ্বীপে বসে সাপের বিষ থেকে আবিষ্কার করে ফেলেন মারণ ক্যান্সারের প্রতিষেধক। অমূল্য এই আবিষ্কারের লোভে তাঁরই যমজ ভাই সুধন্য সান্যাল সুমন্ত্র সান্যালকে গুম করে রাখেন। অবশ্য মিতিনমাসির মগজাস্ত্রের কাছে সহজেই হার মানেন সুধন্যবাবু। অতুল বৈভবের বদলে তার কপালের বৈগুণ্যে আশ্রয় জোটে সংশোধনাগারের ছোট্ট কুঠুরিতে।

দে’জ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত ‘তিন মিতিন’ গ্রন্থে তিনটি গল্প একত্রে আছে। ‘বিষ’ উপন্যাসে গড়িয়াহাটের এমারেল্ড টাওয়ারের আটতলায় বসবাস করা এক পশ পরিবারের ভদ্রমহিলা ইন্দ্রাণীদেবীর সাথে তাঁর জামাইয়ের অবৈধ সম্পর্কের কথা জেনে ফেলে তাঁর মেয়ে রুমকি। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে মায়ের চায়ের কাপে প্রতিদিন একটু একটু করে আর্সেনিক মিশিয়ে তাঁকে স্লো পয়জনিং এর দিকে ঠেলে দেয় রুমকি। দেহে সেঁকো বিষের লক্ষণ ফুটে ওঠায় সন্দেহ জাগে ইন্দ্রাণিদেবীর। তিনি মিতিনকে নিয়োগ করলে রুমকি একদিন সকলের অলক্ষ্যে মাকে টেনশন কমানোর দুটি বিপরীতধর্মী ওষুধ খাইয়ে খুন করে। মিতিন সবটা বুঝে গেলে রুমকি নিজেও ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করে। ‘তৃষ্ণা মারা গেছে’ উপন্যাসে দুই কর্মরতা যুবতী তৃষ্ণা ও সুকন্যা একই বি.পি.ও তে কাজ করে। দুজনের মধ্যেই প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। কৌশিক নামের ভদ্র এক ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় তৃষ্ণার। কিন্তু তৃষ্ণার অতীত জীবনের কোন গোপন ঘটনা জানা ছিল বলে প্রশান্ত সেন নামের এক অসাধু লোক তাকে ব্ল্যাকমেল করতে থাকে। এই চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয় তৃষ্ণা। তার আত্মহত্যার মোটিফ ও ধরণ খোঁজাই এ উপন্যাসে মিতিনের প্রধান অণ্বিষ্ট। ‘মারণ বাতাস’ উপন্যাসের সমস্যাও মূলত একটি পারিবারিক সমস্যা। সরকারি চাকুরে সুদর্শন সৌম্যরূপ রায়চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় চিত্রলেখার। বিয়ের কয়েকমাস পরেই একটি  অ্যাক্সিডেন্ট এ প্রতিবন্ধী হয়ে যায় সৌম্যরূপ। চিত্রলেখা প্রায় দেড় বছর স্বামীর সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করে শেষে ডিভোর্সের পথে হাঁটে। এদিকে সৌম্যও  তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে পড়ে। সৌম্যরূপের মা অপর্ণা দেবী ছেলে সৌম্যকে দগ্ধে দগ্ধে মরার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে ও যুগপৎ বৌমা চিত্রলেখাকে দায়ী করে দিতে চেয়ে খালি ইঞ্জেকশানে শুধু বাতাস পুশ করে ছেলেকে মেরে ফেলেন। পুলিশ চিত্রলেখাকে প্রথমে গ্রেপ্তার করলেও পরে মিতিনের উপস্থিত বুদ্ধিতে  আসল অপরাধী ধরা পড়ে। এই তিনটি উপন্যাসই তথাকথিত বড়দের প্রেম-প্রণয় ও পারিবারিক সমস্যা নিয়ে আধারিত বলেই সম্ভবত তাদের আলাদা প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন লেখিকা। এবং সম্ভবত একই কারণে এই উপন্যাসগুলির কোনোটিতেই শিশুমনের সঙ্গী টুপুরকে সহযোগী হিসাবে দেখতে পাওয়া যায়না।

সুচিত্রা ভট্টাচার্যের পরিমার্জিত ও নাগরিক লেখনীর আস্বাদ মিতিনমাসির অন্য উপন্যাসগুলিতেও বেশ স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে বর্তমান। চরিত্রানু্যায়ী ভাষাচয়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও কোথাও কোথাও নাগরিক মননের সাথে অতিরিক্ত যোগাযোগ বা ইপ্সিত পাঠককুলকে প্রধানত শহরঘেঁষা ধরে নেওয়ায় গল্পগুলির ভাষাতে একধরণের শহুরে ছাপ যেন প্রান্তবাংলার পাঠকদের সাথে কোথাও একটা দূরত্ব তৈরি করেছে বলে মনে হয়। তবে গোয়েন্দা গল্প বলে যে এর ভাষায় কোনো একঘেঁয়েমি তৈরি হবে এমন কোনো অবকাশ লেখিকা রাখেননি, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রকৃতি, স্থান, ইতিহাস বা কোনো ঘটনার বর্ণনায় তা যথেষ্ট সুখপাঠ্য ও সাহিত্যগুণান্বিত। যেমন ‘সর্পরহস্য সুন্দরবনে’র চন্দ্রবোড়ার বর্ণনা -  

সত্যিই দেখবার মত চেহারা। হাততিনেকের বেশি লম্বা নয় বটে তবে বেশ নধরকান্তি। রঙ সোনালি আর বাদামির মাঝামাঝি। গায়ে বড়বড় কালচে ছোপ, যেন কোনও শিল্পীর তুলিতে আঁকা। একজন ঘুমোচ্ছে, অন্যজন ঘুরে বেড়াচ্ছে অলস পাহারাদারের মত। উঁকি দিচ্ছে চেরা জিভ, মিলিয়ে যাচ্ছে পরমূহুর্তে।

পার্থমেসোর ভাষায় আবার কলকাতার আঞ্চলিক শব্দ বা কোথাও কোথাও রকের ভাষা থেকে নেওয়া শব্দ (যেমন খিল্লি, বারফাট্টাই, মাল ইত্যাদি) বসিয়ে নারীশক্তির প্রকৃত ক্ষমতা সম্পর্কে চিরকালের সন্দিহান পুরুষতন্ত্রের আত্মম্ভরিতাপূর্ণ দম্ভের আসল রূপটি উন্মোচন করে দেন অনায়াসে, আর পার্থর মিতিনকে করা ‘শ্রীমতী টিকটিকি’ বা টুপুরকে করা ‘চামচি’ সম্বোধনে যে  ইষৎ ব্যঙ্গ থাকে, তাকে স্বতঃস্ফূর্ত মেধায় ও শিক্ষিতা নারীর আধুনিকত্বে অবহেলায় অতিক্রম করে যায় মিতিন ও টুপুর। 

গোয়েন্দা গল্পকে হতে হবে সাধারণ জ্ঞানের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার – প্রচলিত এই মতকে মান্যতা দিয়ে মিতিনমাসির মাধ্যমে পাঠকসাধারণের সমক্ষে অনেক অজ্ঞাত বা অল্পজ্ঞাত বিষয়বস্তুকে সুন্দর তথ্যঋদ্ধ করে তুলে ধরেছেন সুচিত্রা। মিতিনমাসি পড়েই কোনো উৎসুক পাঠক জেনে নিতে পারবেন বিভিন্ন সাহিত্যিক সংক্রান্ত তথ্য, বিশ শতকের নস্ট্যালজিয়া টেলিফোন বুথ বা ‘রোডর‍্যাশ’ কম্পিউটার গেমের কথা, অন্যপ্রাণী অপেক্ষা মানুষের বুদ্ধির বহর, পার্সি-চীনা-অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানদের বিভিন্ন রীতিনীতি-উৎসব, সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত ‘মেরলিয়ন’ সিংহের মূর্তি, পার্সিদের আদলে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার মত নানা প্রয়োজনীয় অথচ শিশুকাহিনীতে এযাবৎ স্বল্পালোচিত তথ্য। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখনীর মত অমিতাভ চন্দ্রের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ ডিটেইলিং এর দিক থেকে গল্পগুলিকে একটি অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়।

সাহিত্যিক তাঁর প্রিয় চরিত্রদের নির্মাণ করেন বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে আপনমনের মাধুরী পছন্দমত মিশিয়ে। রক্তমাংসের মানুষও যেমন দোষে-গুণে ভরা হয়, তেমনি সৃষ্ট চরিত্রেরও কিছু ধনাত্মক দিক বা শক্তির পাশেই বসত করে কিছু দুর্বলতার ঋণাত্মক দিকও। মিতিনমাসির চরিত্রের প্রধান শক্তির দিক হল এটাই যে তাকে দেখে কেউই প্রথম দর্শনে গোয়েন্দা বলে ভাবতে পারেনা, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামী পার্থ, বোনঝি টুপুর ও শিশুপুত্র বমবুমের উপস্থিতি। এছাড়াও প্রখর মেধা, বিবিধ বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান, সুস্থ সবল গোয়েন্দাসুলভ শরীর মিতিনমাসির শক্তির অন্যান্য দিক। আবার গল্পের গঠনগত দিক দিয়ে বিচার করলে পরিবার পরিজনের গল্প, ঘরকন্নার কথা  ইত্যাদি কোথাও কোথাও কাহিনীকে বেশ শ্লথ করে দিয়েছে। ফলস্বরূপ কোন ১২০ পৃষ্ঠার উপন্যাসে কোথাও প্রায় ৫০ পৃষ্ঠার পর পাঠক পেয়েছে রহস্যের প্রথম গন্ধ। সে অর্থে দেখতে গেলে বাংলার অন্য কোনো বিখ্যাত গোয়েন্দা গল্পে তেমনভাবে তাদের পরিবারের কথা নেই, অনেকের তো কোন উল্লেখই নেই, যেমন ফেলুদা অবিবাহিত, ‘ব্যোমকেশ’এও সত্যবতী ও ব্যোমকেশের পারিবারিক বর্ণনা তেমন গুরুত্ব পায়নি খুব বেশি। অন্যান্য গোয়েন্দাদের মত ব্যক্তিগত শত্রুও কখনও তৈরি হয়নি মিতিনমাসির। লেখিকা তাকে কখনোই সে অর্থে মৃত্যুমুখে পতিত করে তার সাহসিকতার পরিচয় নেননি বা কোনো শত্রুর হাতে বন্দী থাকতে হয়নি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যা পাঠকদের গোয়েন্দাকেন্দ্রিক উন্মাদনা ও স্নায়ুর উত্তেজনা বাড়িয়ে দিতে  পারত শতগুণে।

সর্বোপরি বলা যায় যে, গল্পের তীব্র প্যাঁচ-পয়জার, সর্বক্ষণ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে রাখা, গোয়েন্দার কোন বাতিক বা অভ্যাস, হঠাৎ হঠাৎ ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য ঘটনাস্রোত বা জোরালো গা ছমছমে আবহ প্রভৃতির অনুপস্থিতি বা স্বল্পতা মিতিনমাসির কাহিনী তথা গোয়েন্দা সত্তাকে ফেলুদা, ব্যোমকেশ বা কাকাবাবুর উত্তরসূরি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও লেখিকা পূর্বোক্ত যে উদ্দেশ্যে মিতিনমাসিকে নির্মাণ করার কথা বলেছিলেন তা অনেকাংশেই সফল হয়েছে বলা যায়। তবে গোয়েন্দাপ্রধান গোয়েন্দা কাহিনীর কাঠামোয় বিচার করলে মিতিনমাসির উপন্যাস বা গল্পগুলি কতটা ‘গোয়েন্দা’ গল্প আর কতটাই বা গোয়েন্দা ‘গল্প’ সে প্রশ্নের অবতারণা ও তর্কের ভার অনাগত কালের পাঠক ও চিরচলিষ্ণু সময় এই দুই বিচারকের হাতে ন্যস্ত করে এই প্রবন্ধের এখানেই আপাতত ইতি টানছি।   


তথ্যসূত্রঃ-       

১. সলিল চৌধুরী রচিত গণসঙ্গীত, ‘হারাণের নাতজামাই’ সিনেমাতেও ব্যবহৃত হয়েছে পরে।

২. ভূমিকা, ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’, সিমন দ্য বোভোয়ার, অনুবাদ- হুমায়ুন আজাদ, (দ্বিতীয় সংস্করণ ) আগামী প্রকাশনী,   ঢাকা, ১৯৯০।

৩. ‘পদ্মরাগ’ঃ কালজ-কালোত্তর(প্রবন্ধ), অমলকুমার মিত্র, ‘বিংশ শতাব্দীর নারী-ঔপন্যাসিক’, সম্পাদনা –   অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, পূর্বা, কোলকাতা, ২০০১।

৪. ‘বাঙালি মেয়ের হাল-বেহাল’(প্রবন্ধ), রুশতী সেন, ‘বিশ শতকের বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি’, সম্পাদনা – স্বপন বসু ও হর্ষ দত্ত, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০০।

৫. ‘সর্পরহস্য সুন্দরবনে’, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, আনন্দ প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৪।

উল্লেখপঞ্জীঃ-

আজাদ হুমায়ুন আজাদ, ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (অনুবাদ, দ্বিতীয় সংস্করণ), সিমন দ্য বোভোয়ার, ‘দ্য সেকেণ্ড সেক্স’, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা,  ১৯৯০।

 বসু  স্বপন বসু ও হর্ষ দত্ত (সম্পাদিত),‘বিশ শতকের বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি’, পুস্তক    বিপণি, কলকাতা, ২০০০।

ভট্টাচার্য-১  অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, (সম্পাদিত), ‘বিংশ শতাব্দীর নারী-ঔপন্যাসিক’, পূর্বা, কোলকাতা,       ২০০১।

ভট্টাচার্য-২  সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘মিতিনমাসি সমগ্র’, ১ম খণ্ড, আনন্দ, কলকাতা, মার্চ,২০১৫।

ভট্টাচার্য-৩  সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘তিন মিতিন’, দে’জ, কলকাতা,২০০৮ ।

ভট্টাচার্য-৪  সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘সারাণ্ডায় শয়তান’, আনন্দ, কলকাতা, ২০০০।

ভট্টাচার্য-৫  সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘আরাকিয়েলের হীরে’, আনন্দ, কলকাতা, ২০০১।

ভট্টাচার্য-৬ সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘গুপ্তধনের গুজব’, আনন্দ, কলকাতা, ২০০৪।

ভট্টাচার্য-৭ সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘ছকটা সুডোকুর’, আনন্দ, কলকাতা, ২০০২।

ভট্টাচার্য-৮ সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘পালাবার পথ নেই’, আনন্দ, কলকাতা, ১৯৯৮।

ভট্টাচার্য-৯ সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘জোনাথনের বাড়ির ভূত’ , আনন্দ, কলকাতা, ২০০৬।

ভট্টাচার্য-১০ সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য’, আনন্দ, কলকাতা, ২০০৩।

ভট্টাচার্য-১১ সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘সর্পরহস্য সুন্দরবনে’ , আনন্দ, কলকাতা, ২০০৭।

ভট্টাচার্য-১২ সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘হাতে মাত্র তিনটি দিন’, আনন্দ, কলকাতা, ১৯৯৯।

ভট্টাচার্য-১৩ সুচিত্রা ভট্টাচার্য, ‘স্যাণ্ডর সাহেবের পুঁথি’,  আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী, কলকাতা, ২০১৫।

ভট্টাচার্য-১৪ সুতপা ভট্টাচার্য, ‘দেখার আনন্দ, দেখার যন্ত্রণা’(প্রবন্ধ), ‘বিশ শতকের বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি’, স্বপন বসু ও হর্ষ দত্ত (সম্পাদিত), পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০০।

মল্লিক ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক, ‘অপরাধজগতের ভাষা ও শব্দকোষ’, দে’জ, কলকাতা, ১৯৯৩।

সেন রুশতী সেন, ‘বাঙালি মেয়ের হাল-বেহাল’(প্রবন্ধ), ‘বিশ শতকের বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি’,   সম্পাদনা – স্বপন বসু ও হর্ষ দত্ত, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০০।


By Anshuman Roy


Recent Posts

See All
Mother I Am Alive

By Adesope Adisa The essence of my gender and being a woman has been something I struggled to grapple in my words on said, glances observed and in the synthesis of my surroundings in my subconscious.

 
 
 
The Invisible American

By Rishika Tipparti graduate student killed in January 2023 by a speeding Seattle Police officer, who was going 74 mph in a residential area. He later mocked her worth, stating that she had “limited v

 
 
 

Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
bottom of page