যোগসূত্র
- Hashtag Kalakar
- Oct 11
- 5 min read
By Farida Parveen
জ্যোৎস্না বিধৌত চরাচর। চারপাশ জুড়ে এক মায়াবি আলোর ছটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেন এক রহস্যময় জগৎ! হাওয়ার হিল্লোল আশপাশের গাছগাছালিতে কাঁপন তুলে এক অনাবিল প্রশান্তি ছড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রবহমান হাওয়ায় ভেসে আসছে ছাতিম ফুলের সুগন্ধ!
বৃষ্টি আলোকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ভাবি, এখন কী আশ্বিন মাস?
_____ হবে, হয়তো! আমি আবার মাস-তারিখের হিসেব রাখিনা। কিন্তু কেন, কী জন্য বলোতো?
_____ এই জন্য জিজ্ঞেস করছিলাম যে, আশ্বিন মাসেই ছাতিম ফুল ফোটে আর চতুর্দিক সুগন্ধে ভরে যায়। ছাদে ওঠে আসার পর থেকেই তো ছাতিম ফুলের সুগন্ধ ক্ষণে ক্ষণে নাকে এসে ঝাপটা দিচ্ছে_____
_____ ও, এই কথা। আশ্বিন মাস কিনা জানিনা। তবে, আমাদের পুকুর পাড়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু ছাতিম ফুলের গাছ। হয়তো ফুলও ফুটেছে! তাই হয়তো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। বৃষ্টি, তোমার ভাল লাগছে এই সুগন্ধটা!
_____ হ্যাঁ। এই যে জ্যোৎস্না বিধৌত চরাচর। প্রবহমান হাওয়ায় ছাতিম ফুলের সুগন্ধ ভেসে আসা_____ সব মিলিয়ে এক অন্যরকম পরিবেশ মনে হচ্ছে। একটা স্বপ্নালু আবহ। আচ্ছা ভাবি, এখন রাত ক’টা বাজতে পারে বলে তোমার অনুমান হয়?
_____ সঠিক বলতে পারবনা, যখন ছাঁদে উঠে আসি_____ দেখলাম, কামরার ঘড়িটায় দশটা বেজে দশ মিনিট। সময়ের হিসেব রাখতে নয়। ঘড়ির দিকে নজর পড়ায় সময়টা মনে আছে। তাই, অনেকক্ষণ ধরে তো আমরা দুজনে এখানে বসে রয়েছি, ঘণ্টা খানেক তো হবেই_____ সেটা অনুমান করে বলা যায়, এগারোটা দশ বা পনেরো মিনিট বা তার কাছাকাছি হবে।
বাড়ির প্রবেশ পথে লোহার যে ভারী গে’টটা রয়েছে, ক্ষণে ক্ষণে আলো সেদিকে দৃষ্টিপাত করছে দেখে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করে, তুমি কী কারোর জন্য অপেক্ষা করছ?
_____ হ্যাঁ, আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায় বলো তো? রাত তো অনেক হল।
আলোর হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে একটু অবাক হয় বৃষ্টি। কিছুই অনুমান করতে পারছে না যে আলো ভাবি কার জন্য অপেক্ষা করছে!
বৃষ্টি জিজ্ঞেস না করে পারেনা, কার জন্য অপেক্ষা? ইমন ভাইয়া তো ঘরেই রয়েছে। একসঙ্গে তো রাতের খাওয়া-দাওয়ার পাটও চুকল। ফুফু-আব্বাও যার যার কামরায় চলে গেলেন শুতে। এতক্ষণে হয়তো ইমন ভাইয়াও শুয়ে পড়েছেন। কার জন্য তুমি অপেক্ষা করছ ভাবি?
আলো মাথা দুলায়। আবারও লোহার গে’টের দিকে দৃষ্টিপাত করে। অতঃপর বৃষ্টির মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, এ ঘরের আরও একজন সদস্য রয়েছে, যে এখনও বাইরে_____
_____ কে সে সদস্য?
_____ আমার দেবর। ওর নাম ইরফান।
_____ এত রাতে ও বাইরে কেন?
_____ ওর প্রচুর কাজের ঝামেলা, তাই বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায়।
[১]
[২]
_____ কি এমন মহাকাজ_____ রাত অবধি ফুরোয়না!
_____ আছো তো ক’দিন, স্বচক্ষে সবই দেখতে পাবে। সাড়ে এগারোটা, বারোটা, এমনকি একটাও বেজে যায় কোনও কোনও রাতে ইরফানের বাড়ি ফিরতে। ওতো স্থানীয় এক দৈনিক সংবাদ পত্রের বার্তা সম্পাদক। এবার বুঝতেই পারছো, কাজের বহরটা কি রকম!
বৃষ্টি ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। বলে, সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু তুমি অপেক্ষা করবে কেন? ফুফু রয়েছেন, রয়েছে কাজের মহিলা_____
আম্মা তো অসুস্থ। মধুমেহের রোগী। রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে। আর কাজের মহিলা! সমস্ত দিন খাটা-খাটুনির পর রাতের বেলাও কি বিশ্রাম নেবেনা? তাই আমি জেগে থেকে ইরফানের অপেক্ষা করি_____ ভাত বেড়ে দেই। তরকারি গরম করে পরিবেশন করি। যেন সে অনুভব করতে পারে স্নেহের স্পর্শ! তাছাড়া ইরফানকে আমি দেবর হিসেবে দেখিনা, কারণ আমার আপনজন বলতে আম্মা-আব্বা, ভাই-বোন কেউই ইহজগতে নেই, ওকেই আমি ভাই হিসেবে মনে করি।
বৃষ্টি অনুধাবন করতে পারে, আলোর মনটা শুধু ভাল নয়_____ কোমলও।
আলো কথায় কথায় বলে, এই যে এখানটায় আমরা বসে রয়েছি_____ আমার বড্ড প্রিয় জায়গা। এই জায়গাটায় এসে বসলে নিজের মধ্যে যেন একাত্ম হতে পারি।
বৃষ্টির বুঝতে অসুবিধা হল না যে, কোনো এক অব্যক্ত বেদনা আলোর হৃদয় কুরে কুরে খাচ্ছে!
কিন্তু না। পরমুহূর্তে আলো ঝলমলিয়ে হেসে ওঠে। তাহলে কি বৃষ্টির ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত! হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। হিমেল হাওয়ায় ছাতিম ফুলের সুগন্ধের ন্যায় সুখ-দুঃখ কি নিরন্তর দোলা দিচ্ছে আলোর হৃদয়ে!
বৃষ্টি আর আলোর কথোপকথনের মাঝে লোহার গে’ট খুলে দুড়দাড় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে আসে ইরফান।
ইরফান ভাল করে বৃষ্টির মুখাবয়ব নিরীক্ষণ করে একটা অপরিচিতের দূরত্ব তৈরি করে।
আলো ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলে, তোমার মামাতো বোন অথচ চেনোনা। আজ সন্ধ্যে বেলা হোজাই থেকে মামা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন_____
ইরফান উৎফুল্লিত কণ্ঠে বলে ওঠে, তুমি বৃষ্টি না! সেই ছোট্ট বৃষ্টি এখন কত বড় হয়ে গেছে!
বৃষ্টি লাজুক হাসে। আর মনে মনে ভাবে, আত্মীয়-স্বজন থেকে মায় পাড়াপড়শি সকলে একঝলক দেখলেই ওকে বলে বড় হয়ে গেছে। কত বড়? লম্বা-চওড়ায় ওকে দেখতে বেশ বড়-ই মনে হয়। আয়নায় নিজেকে দেখে ওরও তাই-ই মনে হয়। তারপর সেই অনাকাঙ্কিত ব্যাপারটার মুখোমুখি ওকে হতে হয়। হোজাইর হাম হাসপাতালে ওকে ওর আব্বা নিয়ে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওর জীবনটা হঠাৎ করে এলোমেলো হয়ে যায়। তাই তো শিলচরে ওর ফুফুর বাসায় চলে আসে।
(২)
ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টিকে দেখতে পেলেন না আলেয়া। রাতে ওঁনার পাশে ঘুমিয়েছিল, যদিও আলোর সঙ্গে বেশ রাত অবধি ছাঁদে ছিল, তারপর কখন এসে পাশে শুয়েছিল! আলেয়ার মাঝ রাতে একবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, প্রায় রাতেই এভাবে ঘুম ভেঙে যায়। আগে এরকম হতো না। ইমন-ইরফানের আব্বার মৃত্যুর পর থেকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকলেও, হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায়। এর কোনো কারণ খুঁজে পাননি আলেয়া। তা-ও তো বহুবছর হয়ে গেছে স্বামীর মৃত্যুর! ছেলেরা মায়ের সব ধরণের খেয়াল রাখে আর পুত্রবধু হিসেবে আলো তো আলোকিত এক নক্ষত্র। কোনো অভাব-অভিযোগ নেই আলেয়ার তবু কেন রাতের বেলা হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায়! গত রাতেও ঘুম ভাঙার পর দেখেছিলেন ওঁর পাশেই বৃষ্টিকে অঘোরে ঘুমতে। এত ভোরে ঘুম থেকে ওঠে কোথায় গেল?
আলেয়া বাইরে বেরিয়ে এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে নেন, কোথাও কি বৃষ্টিকে দেখা যাচ্ছে! সেই ছোটবেলা এসেছিল। কিশোরি বয়সে এই এল। যদি গে’ট খুলে বড় রাস্তায় হাঁটতে বের হয়_____ দিনকাল তো ভাল নেই, এমনিতেই বৃষ্টির জন্য আলেয়ার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই এই প্রথম ইমন আর আলোর কামরা থেকে উচ্চস্বরে কিছু কথাবার্তা ওঁর কানে আসে। সেই পুরনো বচসা আবারও কি নূতন ভাবে দেখা দিয়েছে! কিন্তু চার দেয়ালের ভিতরেই সেটা সীমাবদ্ধ ছিল। ইমন মাঝে মাঝে আলোর সঙ্গে খুবই রূঢ় ব্যবহার করে ! বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আলেয়া ভাবেন, ইমন কী আবারও বিয়ে করতে চায়? কার দোষ কে জানে! এই পুরুষ তান্ত্রিক সমাজে আলো সত্যিটা প্রমাণ করবে কীভাবে!
নাহ! ইমনের গলা আরও একটু চড়ল, আমাকে একটা সন্তান দেবার মুরোদ নেই তোমার!
কান্নাভেজা কণ্ঠে কি যেন বলে আলো_____ আলেয়ার বুঝতে অসুবিধা হয়। হাসিখুশি মেয়েটার চোখের জল যে সহ্য হয় না। তিনি ওর শ্বাশুড়ি নন_____ মা। সেও তাই ভাবে। ব্যাপারটা স্তিমিত হয়েও পুনরায় ফিরে ফিরে আসে, আলোর জীবনটা তখন দূর্বিসহ হয়ে ওঠে। মা হয়ে আলেয়া কিছু করতে পারেন না_____
আলেয়া একই ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ভাবেন আলোর সন্তান জন্ম দেবার মুরোদ নেই বলে ইমন যেভাবে খোটা দেয় বা ঝগড়া-ঝাঁটি বাঁধায়_____ একবার দুজনেই ডাক্তারের পরামর্শ নিলেই তো পারে! ছেলেকে বোঝাবেন নাকি!
এমন সময় বৃষ্টি আর বকুলকে এদিক আসতে দেখে আলেয়া একটু জোরের সঙ্গে হাঁক পাড়েন, এ্যাই ইমন? তোর কি হয়েছে বলতো!
বকুল বৃষ্টির বাবা। আলেয়ার ছোট ভাই।
রেগেমেগে ইমন বাইরে বেরিয়ে আসে_____ আর কাচুমাচু ভাব নিয়ে আলো পেছন পেছন_____
আলেয়া ইমনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এত রাগ দেখাসনা তো বাপু! ওই দেখ_____ ওই মেয়েটাকে দেখ_____ বলে বৃষ্টিকে দেখান_____
কি বলতে চান আলেয়া, ইমন বা আলো কিছুই বুঝতে পারেনা!
আলেয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, মেয়েটার অন্ত্রে ক্যান্সার ধরা পড়েছে_____ বকুল মেয়েকে নিয়ে এসেছে মেহেরপুরের কাছাড় ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে।
ইত্যবসরে ওরা বাপ-বেটি এসে উপস্থিত হয়। বৃষ্টি-বৃষ্টির মতোই ঝমঝমিয়ে বলে ওঠে, ফুফু তোমাকে বিছানায় রেখে আমি খুব ভোরে উঠে পড়ি_____ পাখির কলকাকলি শুনে আর শুয়ে থাকতে পারিনি। বাইরে বেরোতেই দেখি, অদূরে পুকুর পাড়ে ছাতিম গাছে অজস্র সাদা সাদা ছাতিম ফুল ফোটে রয়েছে আবার ছাতিম গাছের ডালে ডালে যেন পাখির মেলা বসেছে! সব পাখির তো আর নাম জানিনা। তবে কণ্ঠস্বর আলাদা আলাদা। উফ্ কি যে ভাল লাগছিল! হঠাৎ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, আব্বা যে কখন এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন_____
বৃষ্টির উচ্ছলতা দেখে ইমন-আলো হতবাক! যে মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে_____ এত প্রাণশক্তি কোথা থেকে পেয়েছে!
[৪]
অতঃপর , বৃষ্টি আলোর দুটো হাত চেপে ধরে অবলীলায় বলে, জানো ভাবি_____ আমি আর বেশিদিন বাঁচবনা। ফুফু বলেননি আমার অসুখের কথা! অসুখটা প্রথম যেদিন ধরা পড়ে, মুহূর্তের জন্য আমার পায়ের নীচের মাটি সরে যায়_____ আমার নিজস্ব জগৎটাও এলোমেলো হয়ে যায়। তবে নিজেকে সামলে নিতে খুব একটা দেরি হয়নি। মরার আগে কী আমি মরে যাব! পৃথিবীর রূপ-রস কি উপভোগ করবনা! বৃষ্টির কথায় ইমনের মনে ভাবান্তর দেখা দেয়, যে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও জীবনের সারসত্ত্বটা ভুলে যায়নি_____ আর ওরা জীবনকে উপভোগ না করে নিজেদের মধ্যে মরণপণ লড়াই করছে! আর নয় অহেতুক ঝগড়া-বিবাদ। ইমন অনুতপ্ত হয়ে করজোড়ে আলোর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে।
আলেয়ার যদিও বুঝতে অসুবিধা হয় না, তবে বৃষ্টি নিদারুণ অবাক হয় কারণ, এই কথাগুলো বলার সঙ্গে ইমন ভাইয়া আর আলো ভাবির মধ্যে কি এমন যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে যেতে পারে!
By Farida Parveen

Comments