ভাড়াবাড়ি
- Hashtag Kalakar
- Oct 11
- 5 min read
By Farida Parveen
আজও গলির মুখে এসে কব্জি ওল্টে ঘড়ি দেখলেন প্রসেনজিৎ । সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছ’টার কাছাকাছি। পুরনো অভ্যাস তাই ঘড়ি দেখতে ভুল হয় না। আগে চোখের নিমেষে দেখে নিতেন। দৃষ্টিশক্তি প্রখর ছিল। এখন দিন যত যাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে।
গলির মুখে বেশ উচঁতে মিউনিসিপালিটির যে বাতিটি ঝুলানো আছে, তার থেকে আলোর চেয়ে আঁধারই বেশি।
চোখ বরাবর কব্জি তুলে আনলেন প্রসেনজিৎ, ছ’টা বেজে কুড়ি মিনিট। না, আজ আর দেরি হয়নি। অবসর গ্রহণের পর এই হয়েছে এক জ্বালা। আগে স্কুলের খাটাখাটুনির পর সোজা বাড়ি ফিরতেই মন চাইতো। আর এখন বিকেল হলেই মন আনচান করে। বইয়ের নেশা ছাত্রাবস্থা থেকেই। কিন্তু নেশাটা বেশি বয়সে প্রবল হয়ে উঠেছে। বিকেল হলেই লাইব্রেরীর পথে পা টেনে নিয়ে যায়। এরজন্য বাড়িতে কম বকুনি শুনতে হয় না। আজ অবশ্য বাড়ি ফিরতে দেরি হয়নি। অন্যদিন রাত সাড়ে ন’টা দশটা বেজে যেত।
বাড়ির সদর দরজায় পা দিয়েই মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেন প্রসেনজিৎ। ওঁর প্রায় পাঁচফুটের মতো ছো্টখাটো দেহের সঙ্গে মানানসই ঈষৎ গোলাকার মুখে ফুটে উঠল চিন্তার আঁকিবুকি ছাপ। কান খাঁড়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। দরজার ওপাশ থেকে অস্পষ্ট একটা উচ্চগ্রামের কোলাহল ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ শোনার পর একটা হাই চেপে সদর দরজা ঠেলে বাড়ির ভিতরে পা রাখলেন প্রসেনজিৎ।
পুরনো দিনের দু’তলা বাড়ি, বাড়িতে মোট কামরার সংখ্যা পাঁচ_____ ওপর তলার তিনটিতে থাকেন বাড়িওয়ালা অবিনাশ হালদার। আর এক তলায় কমন্ বাথ্রুমসহ যে দুটি কামরা আছে তাতে থাকেন প্রসেনজিৎ আর ওঁর স্ত্রী সুনয়না।
প্রসেনজিতের চোখে এই অবিনাশ হালদার নামক ব্যাক্তি এক অপূর্ণ চরিত্রের। সব সময়ই যেন শশকের মতো গুটিয়ে রাখেন নিজেকে। ওঁর স্ত্রীর নাম শকুন্তলা। অবশ্য দুষ্মন্তের শকুন্তলা নন। যার আচরণে ন্যায়-নীতি পর্যন্ত ধার-কাছ ঘেঁষে না। জিভেও প্রচণ্ড ধার, সামান্য কথা কাটাকাটি হলেই অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করাটাও ভদ্রমহিলার আয়ত্তাধীন।
অবিনাশ হালদারের বছর তিরিশের যুবক ছেলে কোনোক্রমে মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চশিক্ষার্থে বিশেষ কাবু না করতে পেরে পার্টি ক্যাডার হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় পার্টির নামে চাঁদা তুলে বেড়ায়। কিছুদিন আগে না জেনে এক প্রভাবশালী নেতার আত্মীয়ের কাছ থেকে বড় রকম দাও মারতে গিয়ে মামলায় ফেঁসে যায়। হাজতবাস অবশ্য হয়নি বাপের একে-ওকে ধরার সুবাদে, তবে মামলা-মোকদ্দমা চলছে।
ইট-পাথর বের করা খোলা জায়গাটায় অর্থাৎ যাকে বলে উঠোন, সেখানে পা রাখতেই সুনয়নার তীব্র কণ্ঠের ততোধিক তীব্র আওয়াজ শুনতে পেলেন প্রসেনজিৎ। একটু এগিয়ে গেলেন তিনি। দেখলেন, উঠোনের শেষ প্রান্তে সল্পপরিসরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে_____ সুনয়না_____
_____ কী হয়েছে? সন্ধ্যাবেলায় এত চিৎকার?
প্রসেনজিৎ স্ত্রীকে প্রশ্নটা করলেন কিন্তু উত্তর পেলেন না।
খানিকক্ষণ পর কণ্ঠে কিছুটা ঝাঁঝ মিশিয়ে বললেন সুনয়না, সাধে কী আর চিৎকার করছি? হাত-মুখ ধুয়ে স্নানঘর থেকে বেরিয়েছিলাম মাত্র, ওপর থেকে আলু-বেগুনের খোসা আমার উপর ছুঁড়ে ফেললেন।
প্রসেনজিৎ বরাবর নির্বিরোধী মানুষ। প্রতিবাদ করা ওর ধাতে সয় না।
এবার ওপর থেকে পাল্টা জবাব এল, বললাম তো_____ বিড়াল ফেলেছে হয়তো! আমরা ওসবের কী জানি?
[২]
শকুন্তলার কথা শেষ হতে না হতেই সুনয়না অতর্কিতে একটা অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করে ফেললেন। শোনা মাত্র প্রসেনজিতের চোখ-মুখ গরম হয়ে হল্কা বের হতে লাগল। তিনি স্ত্রীকে বাঁধা দিতে পারতেন, কিন্তু দিলেন না। নির্বিরোধী মানুষরা সংসারে শান্তি আনয়ন করতে অনেক সময় চুপ থাকেন।
_____ ওপর থেকে আলু-বেগুনের খোসা পড়বে নাতো টাকা পড়বে ওড়ে ওড়ে_____
ফের শকুন্তলার তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো কণ্ঠ শোনা গেল।
সুনয়নাও কম যান না। বলেন, তাহলে কী আপনি বলতে চান কিছুই জানেন না? ওপর থেকে আবর্জনা ফেলে বলবেন বিড়াল ফেলেছে! তাও কি সম্ভব?
_____ ভূত রয়েছে_____ এ বাড়িতে ভূত রয়েছে_____ পুরুষকণ্ঠ উত্তর দিল।
প্রসেনজিৎ চকিতে ঘুরে তাকালেন। দেখলেন পিছনে অজয় দাঁড়িয়ে। সে যে কখন এসে নিঃশব্দে পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তা কেউ টের পাননি।
_____ হ্যাঁ। তোমার কথাই ঠিক_____ প্রসেনজিৎ এতক্ষণে কথা বললেন, এ বাড়িতে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক ভূত নিশ্চয়ই আছে। আর তাছাড়া ওপর থেকে যেমন টাকা পড়ার কথা নয় তেমনি আবর্জনা পড়ারও কোনো মানে হয় না।
এবার অরিনাশ হালদারের লঘুস্বর ভেসে এল, স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আহঃ তুমি একটু চুপ করতো।
_____ চুপ করব আমি! শকুন্তলার কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়ল, আমাদের নামে আজেবাজে মিথ্যা কথা বলবেন আর আমরা তা মেনে নেব_____ কক্ষনো না। আর ওঁদের যদি এ বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হয় তা হলে বাড়ি ছেড়ে দিলেই পারেন। আলু-বেগুনের খোসা শরীরে মেখে পড়ে রয়েছেন কেন? আমরা তো আর কাউকে ধরেবেঁধে রাখিনি। আর ওঁরাও এটা জেনে রাখুন, আইন যেমন ভাড়াটের দিকে আছে, তেমনি বাড়িওয়ালাদের দিকেও আছে। আমাদের সঙ্গে লাগতে এলে এমন টাইট দেব না, বাছাধনরা তখন পালাবার পথ খুঁজে পাবেন না।
সুনয়না আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলেন না। রক্তে আগুন ধরল যেন! স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যাওতো ঘরে যে ক’টা স্ক্র-ড্রাইভার আছে, আমাদের টাইট দেবার আগে ওঁদেরকে টাইট দেওয়া উচিত।
প্রসেনজিৎ আর এসব শুনতে পারছেন না, স্ত্রীকে প্রায় হিড়হিড় করে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় সিঁটকিনি এঁটে দিলেন।
দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে চুপ করে বসে রইলেন প্রসেনজিৎ। এটা ওঁর খুব পরিচিত ভঙ্গি, কোনো কিছু গভীরভাবে চিন্তা করার এটাই তার বহিঃপ্রকাশ। সুনয়না কাছে সরে এলেন। দুর্দম বেগে ঝড় বয়ে যাওয়ার পর ধরিত্রী যেরূপ শান্ত হয়ে আসে সেইরূপ এখন সুনয়নার। আস্তে আস্তে বললেন, এখানে আর নয়। অন্যত্র কোথাও চলে যাই, চলো। প্রতিদিনের ঝগড়া-বিবাদ আর সহ্য হয় না।
সহ্য হয় না প্রসেনজিতেরও। অন্যত্র কোথাও চলে যেতে চাইলেও যাওয়া যায় না। ঘর খুঁজলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। হয়তো ভাড়াও দ্বিগুণ গুণতে হবে। এই এলাকায় থাকার সুবিধা হাতে গুণে শেষ করা যাবে না। বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ বাসষ্ট্যাণ্ড। এছাড়া হাসপাতাল, বাজার, ব্যাঙ্ক সব পাশাপাশি। এখানকার জমির প্লট আগুণদরে এখন বিকোচ্ছে। এখানেই তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলেন প্রসেনজিৎ। এই বাড়িতে থেকে দুটি মেয়ের জন্ম থেকে বিয়ে অবধি দিলেন। আবার এই বাড়িতে থাকাকালীন তিনি চাকরি ছেড়ে অবসর নিলেন। আগে এই এলাকাটা খুবই শান্ত ছিল, নিরুপদ্রবও। কিন্তু হঠাৎ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে আরম্ভ হল বিভিন্ন রকম উপদ্রব। অজয় আবার এ পাড়ার উঠতি দাদা। বে-পাড়ায় উপদ্রব করে পাড়ায় এসে আত্মগোপন করে, কখনও ধরা পড়ে, কখনও পার পেয়ে যায়। এলাকায় যত গণ্ডগোল হয় এসব ব্যাপারে প্রসেনজিৎ নির্বিকার। এসব গণ্ডগোল সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে তিনি আলোচনাও করেন না। এই রকম এক মুহুর্তে অবিনাশ হালদার, প্রসেনজিৎ ও নিরূপম ভট্টাচার্যকে একান্ত আলাপ-আলোচনারত অবস্থায় আবিষ্কার করলেন এক হোটেলের সামনে।
নিরূপম ভট্টাচার্য স্থানীয় থানার ও. সি._____ আবার প্রসেনজিতের এক কালীন ছাত্রও বটে। ব্যাস, আর যায় কোথায়! অবিনাশ হালদার প্রসেনজিৎকে অনুরোধ করতে লাগলেন, তিনি যেন ও. সি.-কে বলেন যে অজয়ের মামলাগুলো তুলে দেন।
অবিনাশ হালদারের এসব অনুরোধ-উপরোধ বিশেষ কানেই তুললেন না প্রসেনজিৎ, কিন্তু সেটা যখন নিত্য-নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়াল তখন তিনি অবিনাশ হালদারের মুখের ওপর বলে দিলেন, ও. সি., ওঁর ছাত্র_____ ছেলে হলেও এসব অন্যায় আব্দার নিয়ে তিনি কখনও ওর কাছে যেতেন না। আজও তিনি এ ব্যাপারে যাবেন না। তিনি যেন এসব কথা দ্বিতীয়বার আর না বলেন।
সেই দিন থেকে দুটি পরিবারের মধ্যে প্রীতির রেশ এখানেই শেষ। তার পরিবর্তে শুরু হল বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের সেই চিরাচরিত লড়াই। প্রথম প্রথম ভাড়া বাড়াও। না বাড়ালে বাড়ি ছেড়ে দাও। এছাড়া ওপর থেকে আবর্জনা নীচে ফেলা। প্রতিবাদের সূত্র ধরে ঝগড়া, ফলে চরম অশান্তি।
বোবা দেওয়ালে প্রসেনজিৎ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মনেপড়ে পুরনো বহুস্মৃতি। সে সব স্মৃতি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। এক আশ্চর্য জলছবি যেন!
এ বাড়িতে তিনি যখন প্রথম এলেন, সুনয়না তখন নববধু। তারপর দুই কন্যা রীনা-রেবার জন্ম হল। তারও অনেক পর অবিনাশ হালদার ্বিয়ে করলেন। সুনয়না-শকুন্তলার মধ্যে কত না ভাব তখন। বছর ঘুরতেই ফুটেফুটে অজয়ের জন্ম হল। রীনা-রেবার আনন্দ আর ধরে না। ওকে নিয়েই ওদের সময় কাটতো।
সময় যে কিভাবে কেঁটে যায়! মেয়ে দুটি বড় হল। বিয়ে হয়ে রীনা চলে গেল গোয়াহাটিতে। রেবা রয়েছে শিলচরে। আর প্রসেনজিৎ চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বইয়ের জগতে ডুব দিলেন। মাঝে মধ্যে সস্ত্রীক মেয়েদের বাড়িতে থেকে আসেন। কিন্তু বেশিদিন মন টেঁকেনা। সপ্তাহ খানেক থেকে হাঁফিয়ে ওঠে একরকম পালিয়ে আসেন নিজের জগতে।
আবারও একটা দীর্ঘনিঃস্বাস ত্যাগ করলেন প্রসেনজিৎ।
_____ কী হল কথা বলছোনা কেন?
সুনয়নার কথায় বিব্রতবোধ করলেন প্রসেনজিৎ, কথা বলব কি! কি করব না করব ভেবে পাচ্ছিনা।
_____ সত্যি চতুর্পাশ্বে সমস্ত কিছু অদ্ভত রকম ভাবে পাল্টে যাচ্ছে তাই না_____
কোনো উত্তর না দিয়ে প্রসেনজিৎ বোবা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকেন আগের মতো।
____________X___________
By Farida Parveen

Comments