top of page

পরিচয়

By Farida Parveen


একটুও হাওয়া নেই। গুমোট চরাচর। রাতের আকাশ যেন ভয়ানক কালো। আনোওয়ারা বিছানায় শুয়ে থেকে ওঁর চোখ দুটো মেলে দিয়েছেন কাঁচের জানালা দিয়ে নিঃসীম আঁধারে। চোখের পাতা ওঁর ভারাক্রান্ত, বেদনায়। পাশ ঘেঁষে শুয়ে রয়েছে মেয়ে মনোওয়ারা বিছানায় মিশে গিয়ে। সে জানে ওর মা ঘুমোননি অন্য অনেক রাতের মতো। ধীর গলায় মনোওয়ারা বলে ওঠে, মা, আবারও ওসব ভেবে ভেবে মন খারাপ করছ!  

_____ভাবনার কী শেষ আছে? তোকে নিয়ে কোথায় ভাসি_____  

_____ ঈশ্বর আছেন, তিনি আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন!

_____ তা তো বটেই। কিন্তু মন কী মানে?

_____ মনে করো, বাবা এখনও প্রবাসে রয়েছেন।

_____ তবু তো মনের কাছাকাছি ছিলেন _____ আনোওয়ারার কণ্ঠ কান্নায় বুজে আসে। 

_____ শান্ত হও মা। বাবা না-ই বা রইলেন এ বাড়িতে! দুবাই থেকে ফিরে এসে কি যে হল_____ 

_____ কি আবার হবে! শ্বেখদের মতো বিয়ে করার শখ জেগেছে। আমি কি দোষ করেছিলাম!  

_____ তুমি ঠিকই বলেছ মা। শ্বেখদের মতো বাবারও পুণরায় বিয়ে করার শখ জেগেছে। তবে আমার মনে হয় প্রাচুর্য দেখে সেই মহিলা বাবাকে ফাঁসিয়েছেন! শুনেছি ফেসবুকের মাধ্যমে দুজনের পরিচয়।

_____ হতে পারে। তাই বলে কী ওঁর কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি নেই? 

_____ তুমি এত ঘাবড়ে যেও না তো।

_____ তুই কি বুঝবি! সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রীটা নিলি ইংরেজিতে। সংসারের হালচাল বোঝার এখনও বয়স হয়নি তোর।

_____ না মা, আমি এখন আর নিজেকে ছোট ভাবি না।

_____ তোমার আর আমার সম্বন্ধে করণীয় কি তা আমিই ভাবব এখন থেকে। বাবা আমদের ছেড়ে চলে গেছেন, আমরাও ওঁকে ছেড়ে থাকতে পারি কিনা_____ এটাই হোক আমাদের কৃচ্ছতার প্রথম ধাপ।

_____ তোর এই এক কথা।

_____ এত হা-হুতাশা করোনা তো, পৌঢ় বয়সে বাবার ভিমরতি ধরেছে। বন্ধু মহলে ওঁর এই আচরণে লজ্জ্বায়  আমি মুখ দেখাতে পারছি না। মনে বড় দুঃখ হয়_____ বলতে বলতে মনোওয়ারার গলা বুজে আসে। 

আনোওয়ারাচোখে শাড়ির আঁচল চাপা দেন। বলেন, এমন করে বলিস না। বুক ফেঁটে যায়।

_____ অনুরাধা সেদিন কী বলেছিল জানো?

_____ কী?

_____ তোরা তোদের বাবার কাছে চলে যাস না কেন? এই ঘুপচি ঘরে না থেকে অন্তত লব্ধ প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলির বাংলোয় থাকবি।


[১]   

[২]

_____ তা তুই কী বললি?

_____ এ কথা কী আর বলতে পারি যে তিনি ওঁর স্ত্রী-কন্যা পরিত্যাগ করে চলে গেছেন। বললাম, মা ওঁনার শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবেননা।

_____ চমৎকার বলেছিসরে মনু! তোর বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারি না_____ অনেক রাত হল, একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর। নাহলে শরীর খারাপ করবে।

মনোওয়ারা চোখ বুজে। এক সময় ঘুমিয়েও পড়ে।

(২)

প্রায় মাস দেড়েক হয়ে গেছে মনোওয়ারার বাবা ওদের কোনো খোঁজ-খবর নেননি। একটা ফোন করেও তো জিজ্ঞেস করতে পারতেন, কীরে মনু কেমন আছিস?

মনোওয়ারা ভেবে পায় না যে মানুষ কী করে বদলে যেতে পারে? তাও রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করে ফেললেন ওর বাবা। একসময় মেয়ে-অন্ত প্রাণ ছিল। যদিও মনোওয়ারা মাকে সবসময় অভয় দিয়ে যায় বা  বিচলিত হতে দেয় না। অথচ সে নিজেই ভিতরে ভিতরে চিন্তা-ভাবনায় পুড়ে খাক্‌ হয়ে যাচ্ছে। শরীর দুর্বল হয়ে   পড়েছে। দুর্বল শরীরে রোগব্যাধি বাসা বাঁধে অধিক। অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া লেগে মনোওয়ারার প্রচণ্ড জ্বরের উদ্রেক ঘটে। আনোওয়ারা ঔষধালয় থেকে ঔষধ এনে সেবন করিয়েছেন। ক’দিন ধরেই জ্বরটা ওঠা-নামা করছে। উপশম আর হচ্ছে না। হাতে টাকাকড়িও বিশেষ নেই, যা ছিল খাই-খরচ বাবদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে বলতে গেলে। একান্ত নিরূপায় হয়ে আনোওয়ারা মনোওয়ারার বাবা আব্দুল মান্নানের বাংলোয় উপস্থিত হলেন।

ডোরবেল বাজাতেই চাকর গোছের কেউ হবে সদর দরজা খুলে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে রয়। 

_____ মান্নান আছেন?

_____ হ্যাঁ।

_____ একটু ডেকে দাও তো_____ 

_____ আপনি কে?

_____ আমি! বলবেন, আনোওয়ারা এসেছে।

চাকরটির চোখে-মুখে সন্ধিগ্ধ ভাব। একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে সে যেন ভিতরে চলে যায়। তারমানে আনোওয়ারার প্রসঙ্গ অন্দরে আলোচিত হয়েছে। মান্নানকে ডেকে দেবে তো! মনের মধ্যে প্রবল আশঙ্কা নিয়ে আনোওয়ারা বারান্দায় ওঠে এলেন।

মিনিট পাঁচেকও অতিক্রান্ত হয় না, মান্নান বেরিয়ে আসেন। চেহারায় বিরক্তির ছাপ। আনোওয়ারার আগমন যে কাম্য ছিল না, সেটা ওঁর মুখাবয়বে পরিস্ফট।

_____ কী ব্যাপার?

_____ তোমাকে নিতে এসেছি_____ আনোওয়ারার ব্যাকূল কণ্ঠ।

_____ আমি এখন যেতে পারব না। বিশেষ একটা কাজে বেরোতে হবে।

_____ মনোওয়ারা খুবই অসুস্থ। একটি বার তোমাকে দেখতে চায়_____ 

[৩]

শেষের কথা ক’টি মিথ্যে বললেন আনোওয়ারা।

_____ কী করে যাব? বিশেষ একটা কাজে এখনই বেরোতে হবে।

_____ মনোওয়ারা কি ভাববে! ভাববে, তুমি ওকে অস্বীকার করছ। অথচ একদিন এই মেয়েটি তোমার চোখের মণি ছিল!

এসব কথাবার্তার মধ্যে সেই চাকর গোছের লোকটি এসে উপস্থিত হয়। বলে, ম্যাডাম আপনাকে ভিতরে ডেকে পাঠিয়েছেন।

মান্নানও তড়িঘড়ি ভিতরে চলে গেলেন।

আনোওয়ারা তো তাজ্জব! সুড়সুড় করে নাগিনটার আদেশ অনুযায়ী ভিতরে চলে গেলেন মান্নান। নিজের মান-সম্মানও কী বিক্রি করে দিয়েছেন?

আর মান-সম্মান! মান-সম্মানের ধার ধারলে কি আর বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে না দিয়ে নিজে পুণরায় বিয়ে করতেন! হঠাৎ লোকটি বউ ন্যাওটা হয়ে গেলেন? ওঁর বেলায় তো কখনও এরকম ছিলেন না।

আনোওয়ারার শ্বশুর ছিলেন খুবই গরম মেজাজের। তবে ন্যায়-অন্যায় বুঝতেন। বাবাকে অসম্ভব ভয় পেতেন মান্নান। আনোওয়ারা তখন নববধু। শ্বশুর মহাশয় একদিন ডেকে বলেন ওকে, মা’গো, এ সংসারের দায়-দায়ীত্ব সবই যে তোমার কাঁধে! তোমার শ্বাশুড়ি আজ বেঁচে নেই_____  পরিবর্তে তুমি এদের যত্ন নিও। এদের বলতে মান্নান আর ওঁর তিন বিবাহিতা বোনের কথা বলতে চেয়েছেন। আনোয়ারা অক্ষরে অক্ষরে সে কথা পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু মান্নানকে আঁচলে বেঁধে রাখতে পারলেন না। এ ওঁর অক্ষমতা নয়, দুর্ভাগ্য। 

কতক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ছিলেন আনোওয়ারা_____  মান্নানের কথায় চমকে ওঠেন, এই নাও দু’হাজার টাকা। মনোওয়ারাকে ঔষধ কিনে দিও। 

বারান্দার বাইরে গণগণে সূর্যটা তেজ ছড়ায়। পিপাসায় কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে আনোওয়ারার। তবু দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন, আমি ভিক্ষা নিতে আসিনি। এটাকা আমি ছুঁয়েও দেখবনা_____ বলে হনহন করে বারান্দা থেকে নেমে সবুজ লন্‌ পেরিয়ে বাংলোর গে’ট খুলে বড় রাস্তায় পা রাখলেন।

(৩)

মনোওয়ারা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। মায়ের মমতা, ধৈর্য, কৃচ্ছতা_____ ওকে পুণর্জীবন দান করে। আর সংসারের খাই-খরচ চালাতে গিয়ে আনোওয়ারা ওঁর নিজের সব সোনা-গয়না বিক্রি করে দেন। এছাড়া উপায় তো ছিল না। মনোওয়ারার ঔষধ-পথ্যাদি ছাড়াও সংসারের খরচ বাবদ কত কি-না লাগে। এসবের পিছনে টাকার প্রয়োজন।

মা’কে না জানিয়েই মনোওয়ারা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়। ‘পাত্র চাই’ বিভাগে। প্রচুর সাড়া আসে। তারমধ্যে একজন মামুলি কেরানিকেই মনোনীত করে। এতে অনুরাধা অবাক নাহয়ে পারে না, এ তুই কী করলি? একজন প্রকৌশলি বা ইঞ্জিনিয়ারের মেয়ে হয়ে_____  

মনোওয়ারা কোনো জবাব দেয় না। একটুখানি ম্লান হাসি হাসে। এই টানাপোড়নের মধ্যে একদিন সকাল ন’টা-দশটা নাগাদ মনোওয়ারা সেজেগুঁজে বেরিয়ে যায়। ওর মা আনোওয়ারার নিকট থেকে সামান্য কটা টাকা চেয়ে নিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে রাখে। আর সাজগোঁজ বলতে তেমন আহামরি কিছু নয়। এমনিতেই ওর লম্বা চুল_____ লম্বা চুলে একটা বিনুনি করে নিয়েছে। বিনুনিতে কয়েকটা বেলিফুল গুঁজে দিয়েছে। চোখে হাল্‌কা করে কাজল আর ওষ্ঠে যৎ সামান্য লিপ্‌ষ্টিকের ছোঁয়া! আর একটা সিফনের লাল শাড়ি পরিপাটি করে পরেছে_____ তাতেই ওকে দারুণ মানিয়েছে।

[৪]

মনোওয়ারা যখন ঘরের বাইরে পা রাখে পিছনে এসে দাঁড়ান আনোওয়ারা। জিজ্ঞেস করেন, কোথায় যাচ্ছিস?

_____ এসে বলব।

মনোওয়ারার কথাটা মনঃপূত হয় না আনোওয়ারার। তথাপি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। শুধু মনে মনে ভাবলেন, আজকালকার ছেলে-মেয়েদের কি যে হয়েছে, নিজেদের ওরা অত্যধিক বুদ্ধিমান বলে মনে করে!

খুব একটা সময় অতিবাহিত হয়নি। সম্ভবতঃ তখন দুপুর একটা_____ 

মনোওয়ারা একজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে অবতীর্ণ হয়।

_____ এ কে, মনু?

_____ মা, আমরা বিয়ে করেছি।

মেয়ের দুঃসাহস দেখে আনোওয়ারা মূর্ছা যান আর কি!

যুবকটি এবার এগিয়ে এসে আনোওয়ারার পায়ে হাত রেখে কদমবুচি করে। 

আনোওয়ারা নিরুত্তাপ। মেয়েকে ভৎসর্ণা করে বলেন, আদালতে গিয়ে বিয়ে করে নাম উজ্জ্বল করেছিস না! আমার অনুমতির প্রয়োজন তো লাগবেনা, আমি কে? স্বামী পরিত্যাক্তা এক নারী_____ সমাজে ওঁর কী মূল্য আছে? তুই বড় হচ্ছিস আমি তো দেখতেই পাচ্ছি, বিয়ের ব্যবস্থা আমিই করতাম। এখন সমাজে আমি কীভাবে মুখ দেখাব, বল্‌?

যুবকটি এতক্ষণে মুখ খুলে। বিনীত কণ্ঠে বলে, আমাদের অন্যায় হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দিন। তারপর একটু থেমে বলে, কিন্তু আপনি কী রাজি হতেন আমাকে মেয়ের জামাই করে নিতে?

_____ কেন, তুমি কী কোনো কাজটাজ করো না?

_____ করি, আমি একজন সাধারণ কেরানী। মনোওয়ারা কত বড় বাবার মেয়ে_____ 

যুবকটির শেষের কথায় আনোওয়ারার বুকের ভিতরে একটা হাতুড়ির ঘাঁ পড়ল। তবু নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে বলেন, তাতে কি! চুরি তো নয়। কাজ তো কাজই। যে কোনো কাজকে শ্রদ্ধা করা উচিত। সেটা বড় হোক বা ছোট হোক!

এসব কথায় যুবকটি কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে পড়ে।

আনোওয়ারা আবারও জিজ্ঞেস করেন, তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলতে চাও?

_____ এসবই নয় আমার পরিচয়!

_____ তাহলে?

_____ আমি আমার মা’র জারজ সন্তান_____ যুবকটি অবলীলায় বলল। 

আনোওয়ারা ভিরমি খেলেন যেন! মনোওয়ারা মীমাংসায় আসে। বলে নাসির ওর বাবার পরিচয় না জানলে কি হবে, আমার বাবা থাকা সত্ত্বেও আমি ওঁর পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করি। জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভাল। তাই, নাসিরের ব্যাপারটা জানলে তুমি গররাজি হতে। তুমি অনুমতি দিলে এখন থেকে সে আমাদের সঙ্গে থাকবে, ওর মা ও কিছুদিন পূর্বে বিগত হয়েছেন। মনে করো আজ থেকে নাসির তোমার পুত্র। 

[৫]

নাসিরের কণ্ঠ আদ্র হয়ে ওঠে। বলে মা’গো_____ 

আনোওয়ারা নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননা। মাতৃহৃদয় উথলে ওঠে, বাছা!

বাতাস থমকে যায়। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য পৃথিবী কি স্তব্ধ হয়ে পড়ে!একটি ইষ্টিকুটুম পাখি কোথা থেকে এসে আঙিনায় ডালিম গাছের ডালে বসে অনবরত ডেকে চলে_____ আবার সচকিত হয় বাতাস।

পৃথিবী আগের মতো যেন ঘুরপাক খায়।

আনোওয়ারার কণ্ঠ ভারী। বলেন, মানুষের মনুষ্যত্বই ওর পরিচয়। এসো, ভিতরে এসো_____ 

নাসিরের দু’চোখ ছলছল করে ওঠে, সেটা আনন্দের, না কৃতজ্ঞতার?


By Farida Parveen

Recent Posts

See All
Tides Of Tomorrow

By Nishka Chaube With a gasp of air, I break free from the pearly white egg I’ve called home for the last fifty-nine days. Tears spring to my eyes, threatening to fall on the fuzzy crimson sand and in

 
 
 
An Allusion For Anderson

By Aeriel Holman Once upon a time, in the damp cream colored sand, sat two ingénues silhouetted against a hazy sun. The night has not yet risen behind them, and the scene is awash in a pearly gray and

 
 
 
The Castle of Colors

By Aeriel Holman Everyday I wonder, as I glance out the window, Who truly loves me? Who truly cares? There is no pretending for me here. I must be alone. No Knights dressed to shame the moon call to m

 
 
 

Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
bottom of page