top of page

দেবীপক্ষ

By Tapabrata Das


– “ হে ব্রহ্মা, আমাকে এমন এক বর দিন যাতে আমার মৃত্যু কোনো দেবতা, অসুর বা মানুষ দ্বারা না হয়।”

– “ অমরত্ব সম্ভব নয়, কারণ এটি সৃষ্টির নিয়মের পরিপন্থী। প্রতিটি জীবেরই একদিন মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়।”

– “ তবে পিতামহ আমাকে এমন বর দিন যাতে দেব হোক কি দানব, মানুষ হোক কি পশু, কোনো প্রজাতির নর আমাকে না মারতে পারে।” 

ব্রহ্মা মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “ তবুও মৃত্যুকে এড়ানো সম্ভব নয়। বর দিতে হলে আমি সৃষ্টির মধ্যে কোনো দুর্বলতা রাখতে পারব না। তাই বলো, আর কী চাও?”

মহিষাসুর তখন মনে মনে হাসতে লাগল, কারণ তার পরিকল্পনা ছিল দুর্বল নারীকে বাদ দেওয়া, যাকে সে কখনোই প্রতিপক্ষ বলে ভাবেইনি। অবিচল কণ্ঠে বলল, “ তাহলে হে ব্রহ্মা, আমাকে বর দিন যাতে আমার মৃত্যু শুধুমাত্র কোনো নারীর হাতে হয়। পুরুষের কোনো শক্তি যেন আমাকে স্পর্শ করতে না পারে।”

– “ তথাস্তু…”


সামনের সিটের রডের ওপরে রাখা হাতে কয়েকটা আঙুলের স্পর্শে চমকে পাশ ফিরে তাকালো ভবানী। পাশে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে। সম্ভবত স্কুল থেকেই ফিরছে সে। অন্তত তার পোশাক তাই বলছে। ভবানী পুনরায় সামনে ফিরে তাকালো। আবার হাতে সেই স্পর্শ। ভবানী একটু বিরক্ত হল। সে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি ওর দিকেই চেয়ে আছে। সে অবাক হলো। মেয়েটি কি কাঁদছে! সে কি ওকে কিছু বলতে চায়? সে দেখল মেয়েটি কোনো মতে ওর চোখের জল ধরে রেখেছে। ওর চোখ ভবানীকে নীচে দেখতে ইশারা করল। বেশিনা, একটু নীচে। একটু নীচেই ওর পেট আর তার সামান্য নীচেই কোমরের কাছটায়… ভবানী থমকে গেল। চোখ সরিয়ে নিল। হাতের ওপর সেই স্পর্শটা ভীষণ ভাবে অনুভব করল ও। সে দেখল মেয়েটির কোমরের কাছে একটা অস্থির কালো হাত। যার আঙুলগুলো ঠিক যেন কোনো সরীসৃপের ন্যায় অনবরত ওপর থেকে নীচ কিলবিল করে চলেছে।

হাতটা স্থির হয়ে গেল ভবানীর। সে কি চিৎকার করবে? সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে? সে কি ধরিয়ে দেবে সমাজের এই ঘৃন্য কীটকে সমাজেরই তৈরী করা আইনের কাছে? সে কি মুখ খুলবে? কিন্তু সে তো মুখ খুলেছিল একদিন। বিচার কি পেয়েছিল! পেয়েছিল বোধহয়, লোকটিকে সবাই মারধোর করে বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছিল। কারোর মুখ থেকে পুলিশে নিয়ে যাওয়ার কথাও কানে এসেছিল ভবানীর। কিন্তু মা বাধা দিয়েছিল। বুকে টেনে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে। তবে! তবে তো সে বিচার পেয়েছিল! কিন্তু এ কেমন বিচার যখন সে বাড়ির বাকিদের এই নিয়ে নালিশ করতে গিয়েছিল তখন সেই মা-ই ওকে বাধা দিয়ে গোপনে এনে বলেছিল, “মেয়েদের সঙ্গে এরকম ঘটনা বাসে ট্রামে প্রায়ই ঘটে। সব ঘটনা সবাইকে বলতে নেই। কিছু জিনিস নিজের মধ্যেই চেপে রাখতে হয়।” আর বাইরে? অপরাধটা তো করছিল কেবল একজনই কিন্তু ঘটনাটার পরও কেন বাসের মধ্যে এতো শতশত চোখ তার গায়ে, কোমরে ধারালো আঁচড় কেটে চলেছিল? কেন আড়ালে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে আলোচনা করে যাচ্ছিল ওরা? একজন তো মা-কে বলেই বসেছিলেন মেয়েকে রাস্তা-ঘাটে একা না ছাড়তে।

বড্ডো অসহায় লাগছিল ভবানীর। মেয়েটি অসহায় দৃষ্টিতে তখনও ওর দিকেই চেয়ে। কোমরের ওই কালো হাতটা অদৃশ্য হয়েছে এখন। বোধহয় ভিড়ের মাত্রা অসম্ভব রকমের বেড়ে যাওয়াই এর কারণ। এমন সময় ভবানীর পাশে জানলার ধারে বসা মহিলাটি উঠে গেলেন। 

স্কুল পড়ুয়া সেই মেয়েটি এখন ভবানীর পাশে বসা। বাইরের দিকে মুখ করে অনবরত কেঁদে চলেছে সে। ভবানী মেয়েটির হাতটা শক্ত করে ধরল। মেয়েটি চমকে ওর দিকে তাকাল। একহাতে রুমাল অন্যহাতে একটা দেশলাই বাক্স ধরিয়ে ওকে বুকে টেনে নিল ভবানী। 

বাস থামল। কালো হাতটা বাস থেকে নামল। সঙ্গে নামল ভবানীও। হাতের থলেটা শক্ত করে ধরে লোকটার পিছু নিল সে। কিছুদূর এভাবে চলার পর একটা অন্ধকার গলিতে ঢুকল দুজনে। আর তখনই সুযোগ বুঝে বাঘের মতো ক্ষিপ্র গতিতে পাশ ঘুরে লোকটা অন্ধকারের মধ্যে গলা চেপে ধরল ভবানীর।

– “ কেন রে, কী চাস তুই! বেশ অনেক্ষন ধরে দেখছি আমার পিছু নিয়ে যাচ্ছিস! কে পাঠিয়েছে তোকে, কী চাস?”

ভবানী কোনো উত্তর দেয়না। সে কেবল তার গলার ওপর জড়ানো লিকলিকে কালো সরীসৃপটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

– “ বলবিনা… বেশ!”

বলে লোকটি সামান্য হেসে সামনে ঝুকে ধীরে ধীরে ভবানীর বুকের, ঘাড়ের গন্ধ নিল। তারপর ওর ফরসা ঘাড়ের ওপর চুম্বন করতে করতে ওতে মুখ গুজল। ভবানী অনুভব করল ওর বুকের ওড়নাটা ধীরে ধীরে শরীর থেকে খসে পড়ছে। হাত-পা যেন ক্রমে শীতল ও অবস হয়ে আসছে। হাত থেকে থলেটা পড়ে যেতে চাইছে, কিন্তু… ভবানী থলেটা শক্ত করে ধরল। সজোরে একটা ধাক্কা মেরে লোকটিকে রাস্তায় ফেলে দিল। এই আকস্মিক আলোড়নে থলের ভিতর থাকা তরলটা শব্দ তুলে নিজের অস্থিত্বের কথা জানান দিল। অন্ধকারের মধ্যেই হঠাৎ কোথা থেকে যেন রেডিওর শব্দ শোনা গেল।

দেবী অষ্টাদশভুজামূর্তি পরিগ্রহণ করে শঙ্খে দিলেন ফুৎকার। দেবীর রণ-আহ্বানশব্দ অনুশরণ করে সসৈন্যে ধাবমান হল মহাবলশালী মহিষাসুর। অসুররাজ লক্ষ্য করলেন মহালক্ষ্মীদেবীর তেজঃপ্রভায় ত্রিলোক জ্যতির্ময়, তাঁর মুকুট গগন চুম্বন করছে, পদভারে পৃথ্বী আনতা আর ধনুকটঙ্কারে রসাতল প্রকম্পিত। দেবসেনাপতি মহাশক্তির জয়মন্ত্রের গুণে দেবীকে দান করলেন মহাপ্রীতি।

লোকটির বুকের ওপর পা তুলে গর্জে উঠল ভবানী। তারপর থলের ভিতর থেকে সবুজ বোতলকে বের করল সে। ছিপিটাকে টান মেরে সজোরে খুলে সেটাকে উল্টে ধরল লোকটির শরীর লক্ষ করে। বোতলটার থেকে বেড়িয়ে এলো তীব্র গন্ধযুক্ত একটা গাঢ় নীল তরল। ভিজিয়ে দিতে থাকল লোকটার সর্বাঙ্গ। হঠাৎ ভবানীর চোখদুটো ক্রোধে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল। জ্বলে উঠল ওর হাতে ধরা দেশলায়ের কাঠিটাও।

দেবীর সঙ্গে মহিষাসুরের প্রবল সংগ্রাম আরম্ভ হল। দেবীর অস্ত্রপ্রহারে দৈত্যসেনা ছিন্নভিন্ন হতে লাগল। মহিষাসুর ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তন করে নানা কৌশল বিস্তার করলে। মহিষ থেকে হস্তীরূপ ধারণ করলে; আবার সিংহরূপী দৈত্যের রণোন্মত্ততা দেবী প্রশমিত করলেন। পুনরায় নয়নবিমোহন পুরুষবেশে আত্মপ্রকাশ করলে ওই ঐন্দ্রজালিক। দেবীর রূঢ় প্রত্যাখ্যান পেয়ে আবার মহিষমূর্তি গ্রহণ করলে।

কোনোরকমে ভবানীকে দূরে ঠেলে সরিয়ে ওর হাত থেকে নিজকে বাঁচাতে ঠিক যেন কোনো দিকভ্রান্ত উন্মাদের মতো সে গলির মধ্যে দিয়ে অন্ধকারে ছুটতে থাকল।

রণবাদ্য দিকে দিগন্তরে নিনাদিত, চতুরঙ্গ নিয়ে অসুরেশ্বর দেবীকে পরাজিত করবার মানসে উল্লসিত। দেবীর বাহন সিংহরাজ দাবাগ্নির মত সমস্ত রণক্ষেত্রে শত্রুনিধনে দুর্নিবার হয়ে উঠল। নানাপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গা মধু পান করতে করতে মহিষরূপকে সদম্ভে বললেন, “ গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম্‌। ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।।”

ছুটতে ছুটতে গলির প্রায় শেষ প্রান্তে এসে লোকটি দেখল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। পরনে সাদা জামা, বাদামী ফ্রক। অনেকটা যেন তার মৃতা মেয়েটার মতো। কিন্তু একি ওর হাতে ধরা ওটা কি জ্বলজ্বল করছে! আগুন! এর থেকে বেশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটি মূহুর্ত্তের মধ্যে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠিটা সামনে লোকটার দিকে ছুঁড়ে মারল।

দেবতাগণ সানন্দে দেখলেন, দুর্গা মহিষাসুরকে শূলে বিদ্ধ করেছেন আর খড়্গনিপাতে দৈত্যের মস্তক ভূলুণ্ঠিত। তখন অসুরনাশিনী দেবী মহালক্ষ্মীর আরাধনাগীতিসুষমা দ্যাব্যা পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হল।


– “ মা আমাদের কি পুলিশে খবর দেওয়া উচিত?”

– “ শোন সব ঘটনা সবাইকে বলতে নেই। কিছু জিনিস নিজের মধ্যেই চেপে রাখতে হয়। কিছু আবর্জনা নিজকেই পরিষ্কার করতে হয়।”

– “ কিন্তু…”

– “ কিচ্ছু হবেনা! যা হাতটা ধুয়ে আয়। আর শোন, ওদিক থেকে নেকড়াটা দিয়ে যাস, বড্ড নোংরা হয়ে আছে চারিদিকটা।”


By Tapabrata Das


Recent Posts

See All
The Vacation That Changed Everything

By Nandini Laddha Beside me sits a young woman my age, who incites a somewhat nostalgic feeling inside me- the kind where you desperately try to retrieve the memory of the face in front of you. It loo

 
 
 
Hands That Never Left Me

By Afshan Farheen It started with a chilly wind that made my nose scrunch up. I curled my body inward, afraid I might fall apart. I rubbed my arms as the sounds around me faded into white noise. I kee

 
 
 
Hush

By Ilina Udani I looked out of the window and ran in fear to close the door. The storm raged in a swirling mass of black clouds that seemed to have sucked in all the light from the air, completely blo

 
 
 

49 Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
Rupsa Khatua
Rupsa Khatua
11 hours ago
Rated 5 out of 5 stars.

Osadharan 🔥

Like

Tapabrata Das
Tapabrata Das
a day ago
Rated 5 out of 5 stars.

Unexpected ending 🙏

Like
Tapabrata Das
Tapabrata Das
3 hours ago
Replying to

Thanks

Like

Tapabrata Das
Tapabrata Das
a day ago
Rated 5 out of 5 stars.

Nice story, Keep it up!👍🏻👍🏻

Like
Tapabrata Das
Tapabrata Das
3 hours ago
Replying to

Thanks

Like

Rated 5 out of 5 stars.

Osadharon. Radio playing at the background was truly amazing 👏

Like
Tapabrata Das
Tapabrata Das
5 hours ago
Replying to

Thank you so much❤️

Like

Lata Bari
Lata Bari
2 days ago

nice👍

Like
Tapabrata Das
Tapabrata Das
2 days ago
Replying to

Thank you❤️

Like
bottom of page