দুটি হৃদয়ের মিলন
- Hashtag Kalakar
- Oct 11
- 6 min read
By Farida Parveen
দরজা খুলে এক অচেনা যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অমৃতা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ওর পরিধেয় পোশাক ছিল সালোওয়ার-কুর্তা। ওড়নাখানা গুছিয়ে নিতে নিতে সোজা প্রশ্ন করে “কাকে চাই”?
_____ অনিমেষ ভট্টাচার্য বাড়ি আছেন?
_____ না। বাড়িতে নেই এখন।
_____ কোথায় গেছেন?
এ প্রশ্নের উত্তর সরাসরি এড়িয়ে গেল অমৃতা, কেন, আপনার কোনো প্রয়োজন?
_____ উনার সঙ্গে আমার কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে_____ অমৃতার মনেহল যুবকটি কিছুটা হলেও কুন্ঠিত।
যুবকটির বয়স বেশি নয়। তিরিশে ঘরে হবে। লম্বা-চোওড়া দেখতে। গাত্রবর্ণ ফর্সা। মাথা ভর্ত্তি কুঞ্চিত চুল। মার্জিত পোশাক-আশাকে মনেহল অমৃতার ভাদ্রঘরেরই।
_____ ঘরে এসে বসুন। বাবা ফিরবেন খানিক্ষণে।
অমৃতা দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়। বৈঠকখানায় কুর্সিতে বসতে বসতে যুবকটি দ্বিধাভরা কণ্ঠে বলে, আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা তো!
_____ মানে?
_____ উপযাচক হয়ে একেবারে ঘর অবধি চলে এলাম বলে!
অমৃতা কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বলে, কি নেবেন_____ চা-কফি-ঠাণ্ডা?
_____ না, ধন্যবাদ, কিছু লাগবেনা।
অমৃতা তখনও পর্যন্ত জানেনা যে যুবকটি হচ্ছে ওর হবু বর।
রান্নাঘরে রাঠু ভাত বসিয়ে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিল। অমৃতা গিয়ে বলে, রাঠুদা তুমি ওঘরে যাও। আমি দেখছি।
_____ বসবার ঘরে একজন যুবক বসে আছেন। তুমি যাও তো। বলা যায় না, কি ধরণের লোক_____ আজকাল তো কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। হতে পারে মতলবটা ভাল নয়।
_____ ঠিক বলেছেন দিদিমণি। অচেনা-অজানা কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। সেদিন ওই পাড়ায় দিন-দুপুরে ডাকাতি হয়ে গেল_____
_____ হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি। তুমি যাও।
_____ যাচ্ছি। এক্ষুনি যাচ্ছি।
ভাত হয়ে একটা তরকারি আর একটা ভাজা হয়ে গেল। অনিমেষ বাবুর ফিরবার নাম নেই। এদিকে দুপুর হয়ে এল_____ এক ঘণ্টার ভিতরে চলে আসছি, বলে সেই যে চলে গেলেন, আড়াইঘণ্টা হয়ে গেল এখনও ফেরার নাম নেই। মেয়ের বিয়ে দেবেন বলে উঠেপড়ে লেগেছেন অনিমেষ বাবু। অমৃতা তো সরাসরি বলে দিয়েছিল, বাবা, তুমি মিছেমিছি এ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো। বিয়ে আমি করছিনা_____
অনিমেষ বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন মা, এমন কথা বলছিস কেন?
[১]
[২]
_____ বাবা, বিয়ে সবার জন্য নয়। বিয়েটা হচ্ছে সুখী মানুষের জন্য।
_____ মা’গো, তুই সুখী না? আমি ভেবেছিলাম, তোকে আমি সুখে রাখতে পেরেছি। তোর মা নেই। আমি চেষ্টা করে গেছি, তোর গায়ে একটা আঁচড় পর্যন্ত যেন লাগেনা। এই বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন অনিমেষ বাবু। কিছু একটা আঁচ করতে পেরে অমৃতা দ্রুতবেগে যায় ওঁর পিছন পিছন। গিয়ে দেখে অনিমেষ বাবুর চোখে অশ্রু। ওর মায়ের প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে অশ্রুপাত করে চলেছেন। একই রকম অবস্থা তখন অমৃতারও, কাতরকণ্ঠে বলে, বাবা, তুমি বুঝতে ভুল করেছো। আমার মা নেই, সেটাই আমার দুঃখ। আমার কোনো ভাই নেই, কোনো বোনও নেই, সেটাই আমার দুঃখ। এই দুঃখটা কি কিছু কম! বিয়ে হয়ে আমি চলে গেলে তোমাকে কে দেখবে? কে তোমার সুবিধা-অসুবিধার কথা বুঝবে, বল? তোমাকে একা রেখে আমি একটুও সুখী হতে পারব না।
অনিমেষ বাবু ঘুরে দাঁড়ান, কে বলেছে আমি একা? রাঠু আছে না!
_____ রাঠুদা থাকলে কী হবে? সে-ও তো বুড়ো হয়ে গেছে।
_____ সব মানুষই তো একদিন বুড়ো হয়। মৃত্যুর মতো এ-ও চিরসত্য। আমি চাই মরার আগে তোকে পাত্রস্থ করে যেতে। তোকে সুখী দেখে যেতে চাই। নাহলে আমি পরপারে গিয়েও শান্তি পাবনা।
অমৃতা আর কথা বাড়ায় না। মুখাবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে যে বাবার ইচ্ছেকে মাথা পেতে নিয়েছে।
এসব শুনে অমৃতার বান্ধবী শিখা বলে, তুই এখনও বোকা রয়ে গেলি। তোর বাবা সেকেলের লোক, পছন্দটাও সেকেলে হবে। তা তুই কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারবিনা।
অসহায়ভাবে অমৃতা বলল, তাহলে আমাকে এখন কী করতে হবে?
_____ কি করতে হবে আবার! তোর পছন্দের কোনো ছেলে দেখে তোর বাবাকে বল।
_____ আমার পছন্দের কোনো ছেলে নেই।
_____ আশ্চর্য!
_____ এতে আশ্চর্যের কি আছে! কারণ, তেমন কোনো ছেলে আমার চোখে পড়েনি যে আমার মনে দাগ কাটতে পারে।!
_____ আমি রাতুলকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি। সে কী খারাপ?
_____ রাতুল ভাল না মন্দ, সেটা তোর ব্যাপার। আমি কি বলব?
অমৃতা ওর বাবার ওপর ভরসা করে এক রকম ভয়ে ভয়েই দিন কাটায়।
অনিমেষ বাবুরও পাত্র দেখার বিরাম নেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ছেলে দেখে আসেন। কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না যে সেটা অমৃতা জানতে পারে, রাঠু আর ওর বাবার কথোপকথনের মাধ্যমে।
রাঠু এভাবেই জিজ্ঞেসস করে, বাবা মহাশয়, কিছু হল?
_____ না রে।
_____ বলি দেশে কি সু-পাত্রের আকাল পড়েছে?
_____ না রাঠু, ছেলে তো অনেক রয়েছে। কিন্তু সবাইকে কী পছন্দ করা যায়? কারোর চাল আছে তো চুলো নেই। আবার কারোর সবদিক পরিপূর্ণ তো দেখতে এত কুৎসিত যে আমারই ভীমরতি ধরে। তাছাড়া, আমার অমৃতা মা দেখতে একেবারে অপরূপা। রাঠু, তু-ই বল, তোর দিদিমণি কী দেখতে খারাপ? বিদ্যা-বুদ্ধি সবই আছে_____ কী নেই? ওর সঙ্গে মানায় এরকম ছেলে তো দেখতে হবে। নাহলে মেয়েটা সুখী হবেনা। বিয়ে করে মানুষ যদি সুখী নাহতে পারে, কিসের তবে এই ‘বিয়ে’ নামক শব্দের ভাঁওতা!
(৩)
আড়াল থেকে শুনে শুনে অমৃতার কতদিন ওর বাবার জন্যে গর্বে বুক ভরে গেছে। এরকম বাবা ক’জনের হয়?
অমৃতা দু‘বার বাইরে বেরিয়ে দেখে গেছে, ওর বাবা আসছেন কিনা! তারপর অন্যান্য কাজে জড়িয়ে পড়ে একসময় ভুলে যায়, ওর বাবার ফিরে আসার কথা। বৈঠকখানায় একজন যুবক বসিয়ে রেখে এসেছে সেটাও বেমালুম ভুলে গেছে।
রাঠু এমন সময় এসে বলে, দিদিমণি সুখবর আছে।
_____ সুখবর। কীসের?
_____ বসার ঘরে যিনি বসে রয়েছেন_____
_____ তাহলে?
_____ আমাকে যে পাঠালে অচেনা লোকটাকে নিরীক্ষণ করতে_____
_____ তো কী হয়েছে?
_____ ইনি এ বাড়ির দাদাবাবু হবে।
_____ রাঠুদা, তোমার মাথা খারাপ হয়েছি কি?
_____ না, একটুও না। বাবা মহাশয় ফিরেছেন।
_____ বাবা ফিরে এসেছেন?
_____ হ্যাঁ। বাবা মহাশয় আমাকে বললেন বাজার থেকে ভাল দেখে পাঠার মাংস নিয়ে আসতে। দাও দিদিমণি, বাজারের থলেটা দাও।
অমৃতা হতবাক। হাত থেকে একটা কাঁচের প্লেট এমনি পড়ে গেল কিন্তু কি আশ্চর্য ভাঙলনা!
_____ এমনি হয় দিদিমণি। আমার মেয়ে রচনার যখন বিয়ের সম্বন্ধ আসে, এভাবেই হাতের জিনিষ খসে পড়েছিল। বড় সাধ করে মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিলাম, সুখ কপালে সইলনা। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু ওকে টেনে নিল। সলন্তানটাও বাঁচল না। বেঁচে থাকলে ও এখন তোমার বয়সি হতো দিদিমণি। ওকে বিয়ে দিতাম, নাত জামাই নিয়ে কত খুশি করতাম_____ বলতে বলতে চোকে জল এসে গেল রাঠুর। সঙ্গে সঙ্গে আবার মুছে ফেলে বলল, এমন খুশির দিনে চোখে আবার অমঙ্গল অশ্রু এল কোথা থেকে! দিদিমণি দাও, বাজারের থলেটা দাও_____
_____ রাঠুদা, দুপুর তো গড়িয়ে এল প্রায়, মাংস এনে এখন রান্না করা কী সম্ভব?
_____ না দিদিমণি। যা রেঁধেছো তা নিয়ে অতিথি আপ্যায়ণ করো এবেলা। মাংস আনতে যাচ্ছি রাত্রের জন্য।
তারমানে লোকটা থাকবে আজ? অমৃতা মনেমনে নিজেকেই প্রশ্ন করে।
রাঠু উচ্ছসিত হয়ে বলে, ইনি আজ থাকবেন দিদিমণি। বড় ভাল মানুষ গো দিদিমণি। বড় অমায়িক।
অমৃতা কোনো রকম উচ্ছাস দেখায় না। বাজারের থলেটা রাঠুকে এগিয়ে দিয়ে ভাবল, এটা বড় বেশি আদিক্ষেতা হয়ে যাচ্ছে না!
সন্ধ্যার সময়টায় অমৃতা হেঁসেল ছেড়ে মনের বিশ্রামের জন্য পুকুর ঘাটে নেমে জলে পা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে বসে ভাবছিল, তাহলে ওকে কিছুদিনের মধ্যে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে অন্যত্র। কেমন হবে সেখানের লোকজনেরা। এই লোকটাই বা কেমন! বাইরে থেকে তো সব ভাল। ভিতরটা কেমন, কে জানে? যদি লোকটা খুব জেদি হয়, নিষ্ঠূর হয়_____
_____ আপনি এখানে! আমি সারা বাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান_____ লোকটা অর্থাৎ যুবকটা এক গাল হেসে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এসে বলে, চুপচাপ বসে বসে কি ভাবছেন?
[৪]
অমৃতা অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে যেতে চাচ্ছিল, যুবকটি খুব কাছে এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়_____
_____ আরে উঠছেন কেন, বসুন। এখানে আপনার পাশে বসতে পারি? কোনো আপত্তি আছে?
_____ চলুন, ঘরে চলুন। বাবা দেখতে পেলে কি ভাববেন।
_____লোকটা নির্বিকার হেসে বলে, কী ভাববেন?
_____ জানি না।
_____ আপনি আপনার বাবাকে চেনেননা। আমি জানি উনি কিছু ভাববেননা। এমন উদার লোক পৃথিবীতে হাতে গোনা যায়।
অমৃতা এক রকম বাধ্য হয়েই বসল।
লোকটা কথায় কথায় হাসে। বড় অমায়িক ব্যাবহার। রাঠুর কথাই ঠিক।
_____ আপনার নাম তো অমৃতা। ভারী সুন্দর নাম। আপনার বাবা রেখেছেন?
_____ না, মা রেখেছেন।
_____ আপনার মা’কে মনে পড়ে?
_____ না, আমি তখন খুব ছোট ছিলাম।
লোকটার মুখে দুঃখের ছায়া খেলে গেল। বলল, আপনার তবু বাবা রয়েছেন। আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। মামার সংসারে মানুষ।
অমৃতার কণ্ঠস্বর আদ্র হয়ে আসে, এতদূর অবধি পড়ালেখা, তার খরচ আপনার মামা জুগিয়েছেন?
_____ না। সে ভাগ্য কোথায়? ছাত্র পড়িয়েছি অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে টিউশনি করেছি। সেই টাকায় যাবতীয় খরচ চালিয়েছি। আবার ব্যবসার জন্য অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
_____ কষ্ট না করলে সুখ পাওয়া যায় না, এতকাল শুনে এসেছি শুধু। আজ চোখের সামনে আপনাকে দেখছি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কষ্ট করেছেন বলে আজ আপনি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন। এই বয়সে এতবড় একটা বাবসা দাঁড় করিয়ে একবার পিছন ফিরে দেখুন তো_____
_____ মনেহয় সব স্বপ্ন!
কথায় কথায় সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে রাত্রি তার কলাপ বিস্তার করেছে। পুকুরের জলে তখন চাঁদের প্রতিফলণ হয়, যেন চাঁদ ওদেরকে অগ্রীম শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। এটা তারা দুজনেই উপলব্ধি বা অনুমান করে।
অনেক্ষণ পর অমৃতা কথা বলে প্রথম, চলুন ঘরে যাই।
_____ আরও একটু বসুন।
_____ না এখন বৈশাখ মাস। কেমন হিমহিম হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে। ঝড় উঠতে পারে। বলা তো যায় না। দুজনেই ঝড়ের পূর্বাভাস হৃদয়ে অনুভব করে। এ ঝড় প্রকৃতিকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে এমন নয়, দুটি হৃদয় জুড়ে উথাল-পাতাল হওয়ার ঝড়ো হাওয়া_____ দুটি হৃদয়ের মিলন।
লোকটা অর্থাৎ যুবকটি ঝটিতে উঠে দাঁড়ায়। বলে, তাহলে ঘরেই চলুন।
___________X___________
By Farida Parveen

Comments