কল্পনার ভিতর দিয়ে স্বপ্ন খোঁজা
- Hashtag Kalakar
- Oct 11
- 6 min read
By Farida Parveen
সানোওয়ার জামাকাপড় সব গুছিয়ে রাখাছিল একটা কাপড় রাখার ব্যাগে _____ ব্যাগটি রেখেছে খাটের ওপর। সে উবু হয়ে কাপড় সব ভাঁজ করে রাখছিল _____
পাশেই চেয়ারে বসে রয়েছেন আমেনা বেগম, অর্থাৎ সানোয়ারের মা। বসে থেকে পান চিবোচ্ছেন। পানের স্বাদ সেভাবে পাচ্ছেন না যেন! কৌটো খুলে আরও একটু তামাকগুড়ো পুরলেন মুখে।
আমেনা বেগমের প্রায় সর্বক্ষণের সাথী এই পানের কৌটো _____ যেখানেই বসেন, ওঁর হাতের কাছেই সেটা সব সময় মজুত থাকে। যখন ঘুমোতে যান তখনও বালিশের পাশেই রাখেন। রাতে যদি হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, কৌটো খুলে পান-সুপুরি মুখে একটু দেবেনই দেবেন। এ যেন ওঁর কাছে এক নেশা! রমজান মাসের উপবাসব্রত পালন করেন ঠিকই তবে রোজা ভাঙার সময় বা ইফতারের সময় জলপান করে অন্য কিছু মুখে দেবার আগে সেই গোলাকার ষ্টীলের কৌটো থেকে পান-সুপুরি, তামাকগুড়ো-চূণ সহযোগে আগে সেটা চর্বণ করেন। অথচ আজ কেন যে পানের স্বাদটা তেমন জুৎসই ঠেকছে না।
আমেনা বেগমের চেহারা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে আগামীকাল ওঁর একমাত্র পুত্র সুদূর ইংল্যাণ্ড চলে যাচ্ছে, আবার ক’বছর দেখতে পাবেন না বলে বুকের ভিতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে বুকের ভিতর থেকে কিছু একটা সরে গেছে!
সানোওয়ারের হঠাৎ খেয়াল হয়, ওর মা আজ বড় চুপচাপ।
_____ কী ভাবছ মা?
আমেনা বেগমের ঝটিতি উত্তর, আমি ভেবেছিলাম, তুই বোধহয় এবার আমাকে নিতে এসেছিস।
মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই চট্জলদি সানোওয়ার বলে, নেব। যখন সানিয়ার বিয়ে হবে! নাতনীর বিয়েতে তোমাকে অবশ্যই যেতে হবে।
আমেনা বেগম কথাটা শুনে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। মনে মনে ভাবলেন, নাতনীর বিয়ে পর্যন্ত বয়সের ভার শরীর কি সইতে পারবে! সানিয়া সবে আঠারোয় পা দিল। কলেজ-ইউনিভারসিটি পাশ দিয়ে বেরোতে বেরোতে কত বছর গড়িয়ে যাবে_____ তারপর বিয়ে!
চার বছর আগে সানোওয়ার যখন ইংল্যাণ্ড থেকে এসেছিল, প্রায় কুড়ি-পঁচিশদিন থেকে আবার চলে গিয়েছিল। চার বছর পরই তো সে একবার আসে। সেবার বলে গিয়েছিল, আগামীতে সে যখন আসবে তখন ওঁকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। সেই থেকে তিল তিল করে বুকের ভিতর স্বপ্ন-সৌধ রচনা করে গেছেন _____ ছেলে, বউ, নাতি-নাতনী নিয়ে শেষ জীবনটা ওদের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেবেন। তা আর হলো কোথায়! এক লহমায় স্বপ্ন-সৌধ খান্ খান্ করে ভেঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতো। আর মনে হচ্ছে বুকের ভিতর থেকে কিছু একটা যেন বেরিয়ে গেছে। অনুভূতিটা এমনই যে কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।
জামাকাপড় গুছিয়ে রেখে, ব্যাগের চেন টেনে বন্ধ করে _____ একপাশে ব্যাগটা সরিয়ে আমেনা বেগমের পাশে এবার সুস্থির হয়ে বসল সানোওয়ার।
মায়ের মুখেরদিকে অপলক তাকিয়ে থেকে সানোওয়ার হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, তোমার কী এখানে কষ্ট হচ্ছে?
চকিতে পুত্রের চোখে চোখ রেখে আমেনা বেগম বলেন, বিয়ের পর মেয়েরা বাপের বাড়িতে ফিরে এসে আগের সেই সম্মান পায় না, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কোনও অসম্মান ঘটেনি। বাবা-মা নেই, ভাই-ভাইয়ের বউর সাথে রয়েছি_____ না, আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। তবে, সন্তানের প্রতি স্নেহের বশবর্তী হয়ে_____ সন্তানের কাছে থাকার যে আকূতি, সেটাই আমার কাছে এখন একমাত্র কাম্য এবং এই কাছাকাছি না থাকার অভাবটাই আমার কাছে একমাত্র কষ্টের।
সানোওয়ার কেমন যেন দিশেহারা হয়ে যায়। কোনো সদুত্তর দিতে পারে না। হঠাৎ আমেনা বেগমের হাত দুটো চেপে ধরে। খানিক্ষণ কিছুই বলতে পারে না। সানোওয়ার এবার নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, মা। যাও এবার শুয়ে পড়ো। রাত অনেক হয়েছে_____
রাত তো অনেক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাত পোহালেই ছেলে যে কাছ ছাড়া হয়ে যাবে! সানোওয়ার কালই যে চলে যাচ্ছে_____ ভাবতেই আমেনা বেগমের বুকের ভিতরটা উথাল-পাতাল করে ওঠে, কান্নার উদ্রেক হচ্ছে কিন্তু বহিঃপ্রকাশ ঘটছে না।
তবু, বিনা বাক্যব্যয়ে আমেনা বেগম শুতে চলে গেলেন। কিন্তু ঘুম তো আসছে না। পুরনো কত কথা মাথায় এসে ভীড় করছে_____ স্বামীর কাছে থাকতে সুখ বলে কোনো কিছু ছিল না। যেমন ছিল তিরিক্কি মেজাজ, সেই সঙ্গে দাসীর মতো খাটিয়ে নিতেন। অভাব-অনাটন ছিল না ঠিকই। জমি-জিরেত ছিল অপ্রতুল। তাই কাজের বহরটা ছিল এতটাই, যখন ধান কাটা হতো_____ ফসল তোলা হতো ঘরে, তখন দাসীর সঙ্গে আমেনা বেগমও দাসীর মতো খাঁটতেন। স্নান-খাওয়ার পর্যন্ত সময়সূচী থাকত না। তবুও চোখ বুজে সব সয়ে গেছেন, সানওয়ারের কথা চিন্তা করে_____ ছেলে যে দিন বড় হবে, মায়ের সুখের অন্ত থাকবে না। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সানোওয়ারের বাবা যখন দুম্ করে দ্বিতীয়বার বিয়ে করে বসলেন আমেনা বেগম একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলেন। একে তো যৌথ পরিবারের খাঁটাখাটুনি, উপরন্তু সতীনের উপস্থিতি_____ জীবনটা দূর্বিসহ ঠেকল। যেন তিলে তিলে মরে যাবার উপক্রম! শেষ পর্যন্ত অসুস্থই হয়ে পড়লেন। খবর পেয়ে এপার থেকে ওপারে গেলেন বাবা, মেয়েকে নিয়ে আসতে_____ মাঝখানে যদিও অসম রাজ্যের কুশিয়ারা নদী।
আমেনা বেগম বাবার বাড়িতেই পাকাপাকি ভাবে থেকে গেলেন, স্বামীও খোঁজখবর নিলেন না। পুণরায় ভারতীয় নাগরিকত্ব নিলেন। কিন্তু সানোওয়ারের জীবনটা পড়ে গেল একটা ধন্ধের মধ্যে_____ ক’দিন এপারে তো ক’দিন ওপারে। প্রথানুযায়ী ওদেশেই লেখাপড়া চলতে লাগল। ক্রমে সে কলেজে পা দিল। কলেজের পাঠ চুকিয়েই অধিকাংশ বাংলাদেশের যুবকদের মতোই বিদেশের হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে সুদূর ইংল্যাণ্ডে পাড়ি দিল সানোওয়ার। আপাততঃ লণ্ডনে বসবাসরত। ব্যবসাও জাঁকিয়ে বসেছে। সেই বাবা যিনি ওর মাকে সুখের আধার ভাবেননি, ওঁকেও হজব্রত পালন করায়।
এতদিনে যেন স্বামীর মনে পড়ে আমেনা বেগমকে। ভিসা পাঠিয়ে ডেকে নেন। হজযাত্রার পূর্বাহ্নে আমেনা বেগমকে যখন বলেন, আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি, কোনো খোঁজখবর নেইনি_____ জানি তোমার মনে অনেক কষ্ট জমা হয়ে আছে। আমি এবার আল্লার বাড়িতে যাচ্ছি_____ তুমি যদি আমায় ক্ষমা করে দাও_____
স্বামীর পদতলেই স্ত্রীর স্বর্গ_____ এটা এমনই এক সংস্কার যে আমেনা বেগমও তার ব্যতিক্রম নন, ক্ষমা না করে কি পারেন!
দুঃখ-কষ্ট-বেদনা সব মন থেকে ঝেড়ে মুছে আমেনা বেগম বলেন, এ আপনি কি বলছেন! আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমিও তো আপনার কোনো সেবা করতে পারিনি।
সানোওয়ারের বাবা আদর্শ স্বামী হয়ে গেলেন। ওঁর বিরুদ্ধে স্ত্রীদের কোনো ক্ষোভ নেই। হজব্রত পালন করে যথারীতি বাড়ি ফিরলেন। আমেনা বেগমও প্রাত্যাবর্তন করলেন।
সানোওয়ারের বাবা আর বেশিদিন বাঁচেননি, হাঁফানি-শ্বাসকষ্ট ওঁকে কাবু করে ফেলেছিল। কিন্তু আমেনা বেগম পতিব্রতা স্ত্রীর মতো চারমাস দশদিন স্বামীর জন্য শোক পালন করেছিলেন।
আমেনা বেগমের ঘুম তো আর আসেনা। পুরনো কথাই শুধু ভীড় করছে স্মৃতিতে। এবার ওঠে বসলেন। কৌটো থেকে এক খিলি পান মুখে পুরলেন, বার দুয়েক নাড়াচাড়া করে বিছানা থেকে নেমেই পড়লেন।
[৩]
সানোওয়ার যে কামরায় শুয়ে রয়েছে, টিপে টিপে গিয়ে ওর শিয়রে দাঁড়ালেন। নিয়ন বাল্বের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ওর কমনীয় মুখখানা। আমেনা বেগম নিজেকেই প্রশ্ন করেন, কে বলে সানোওয়ার বড় হয়ে গেছে? মায়ের কাছে সন্তান তো সবসময়ই ছোট!
ঘুম আসছেনা সানোওয়ারেরও। এক অব্যক্ত ব্যথা হৃদয় কুঁরে খাচ্ছে। মাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে না পারার যন্ত্রণা ওকে অস্থির করে তুলছে। কিন্তু সে নিরুপায়। আমেরিকার টুইন টাওয়ার্স ধংস হওয়ার পর থেকে পশ্চিমী দেশগুলিতে বাইরের লোক নিতেই চায় না।
মায়ের উপস্থিতি সানোওয়ার টের পাচ্ছে। টের পেয়েই চোখ বুজে ফেলে, ওর ভিতরটা খান্ খান্ ভেঙে যাচ্ছে! ইচ্ছে করছে মাকে জড়িয়ে ধরে সেই কচি বয়সের মতো হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে। কিন্তু না, এতে মা আরও দুর্বল হয়ে পড়বেন। শেষে না কোনো অঘটন ঘটে যায়!
সানোওয়ারের চোখের পাতা একবার কেঁপে উঠল কিনা আমেনা বেগম ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না। তবু ভাবলেন, সে কী জেগে আছে? পা টিপে টিপে আবার নিঃশব্দে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন। এবার একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করতে লাগলেন। ভোরের দিকে সামান্য একটু ঘুম হল। এই অল্প একটু ঘুমোনোর জন্য কিনা মাথাটা একটু শান্ত হয়েছে। গতরাতের অস্থিরতা এখন আর ততটা নেই। মনটাও শক্ত করে নিয়েছেন এই ভেবে, ছেলেটা আরও ক’বছরের জন্য কে জানে, অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। তিনি যদি এখন কেঁদেটেদে অস্থির করে তুলেন, বিদেশ বিভুঁইয়ে সে কি শান্তি পাবে! না, তিনি একটুও কাঁদবেন না। সানোওয়ার যদি কাঁদেও তিনি স্থির চোখে তাকাবেন, ওকে আশীর্বাদ করবেন।
সকাল বেলাটা এমনি করে কেঁটে গেল, বাদবাকি যা ছিল সব গোছগাছ করতে করতেই সানোওয়ারের। তারপর খেয়েদেয়ে সবাই মিলে সানোওয়ারকে নিয়ে গাড়ি করে রওয়ানা হলেন ইমিগ্রেশন অফিসে। সইসাবুদ সেরে এসে বাইরে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, এখানেও সেই চিরনতুন অনন্ত আকাশ_____ লণ্ডনের আকাশও ঠিক তাই! শুধু পুরনো সেই কুশিয়ারা নদী যা কিনা বাংলার মাটিকে বিভক্ত করে দিয়েছে। অসমের এতদ্অঞ্চলটায় বাংলা ভাষাবাসীদের অবস্থান। ডিঙি নৌকো এসে তীরে ভিড়েছে, তাতে চেপে পাড়ি দেবে বাংলাদেশের জকিগঞ্জে ওর পৈত্রিক নিবাসে। দু’দিন পর ঢাকায়_____ অতঃপর চলে যাবে লণ্ডন। পিছনে পড়ে থাকবেন মা, মাতুলালয় ভারত। আর জন্মভূমি বাংলাদেশ।
এবার বিদায়ক্ষণ_____ একে একে সবার কাছে বিদায় নিয়ে সানোওয়ার আমেনা বেগমের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কান্না সংবরণ করতে গিয়ে ওর ভিতরটা ফেঁটে যায়, মা_____ মাগো_____
এই দুটি শব্দই আমেনা বেগমের হৃদয়ে গিয়ে আলোড়ণ তোলে। কপোল গড়িয়ে নামে জলের ধারা_____
আমেনা বেগমের চোখ দুটি যেন ঝাপ্সা হয়ে গেছে। চোখের জল মোছে তাকিয়ে দেখেন, নৌকা কখন গিয়ে ওপারে ভিড়েছে। সানোওয়ার ওখান থেকে হাত নাড়ছে_____
এপারে, গাড়ি ঘুরিয়ে নেওয়া হয়।
গাড়ি হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে ওঠে, রাজা আমেনা বেগমকে আঁকড়ে ধরে; ভাইপো’র ছেলে অর্থাৎ নাতি, বয়স মাত্র আড়াই বছর।
রাজা আমেনা বেগমের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে রয়েছে। যেন কিছু বুঝতে চায়! লণ্ডনের চাচা চলে গেছেন, সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই, কিন্তু এর সঙ্গে কান্নার যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছে না।
আমেনা বেগম রাজাকে আরও কাছে টেনে নেন। মুখ-মাথা বুলিয়ে দিতে থাকেন। হয়তো রাজাকে নিয়েই এবার স্বপ্ন দেখবেন। ওর হাঁটা, চলা, কথা বলার ভঙ্গি_____ এসবেই খুঁজবেন ছোটবেলার সানোওয়ারকে বা ওর ছোট হাত ধরে হেঁটে যাবেন বয়সের শেষ ধাপে আর সানোওয়ারের প্রতীক্ষায় আবারও দিন গুণবেন। এভাবেই মানুষ কল্পনার ভিতর দিয়ে স্বপ্ন খুঁজে। স্বপ্নবিহীন কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না।
By Farida Parveen

Comments