অবাঞ্চিত প্রেম
- Hashtag Kalakar
- Oct 11
- 5 min read
By Farida Parveen
তুহিনা সেই কখন থেকে একটা নামি-দামী রেস্তরাঁয় বসে রয়েছে অনেক্ষণ থেকে শুভমের অপেক্ষায়। ঘন ঘন হাত ঘড়িটা দেখছে, কিন্তু সে তো আর আসছে না, সময়ও অতিবাহিত হচ্ছে না। একান্ত বাধ্য হয়ে এক কাপ কফি নিল। ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছিল যাতে সময়টা ধীর লয়ে এগোয়_____
গুয়াহাটি চিড়িয়াখানায় ঢুকেই হাতের ডান দিকে যে রেস্তরাঁটা সেটায় বসে শুভমের জন্য অপেক্ষা করছিল তুহিনা। কত লোক টিকিট কেটে চিড়িয়াখানায় ঢুকে পশু-পক্ষী, জীব-জন্তু দেখে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউবা এই রেস্তরাঁয় চা-কফি ইত্যাদি পান করে যাচ্ছে, আইসক্রিম, চকলেট, পেস্ট্রি এ সবই রয়েছে এই রেস্তরাঁটায়। যার যেটা পছন্দ সে সেটা অগ্রীম টাকা দিয়ে নিয়ে নিচ্ছে।
তুহিনা আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবে বা থাকতে পারে! ধৈর্যেরও একটা সীমা-পরিসীমা রয়েছে। অথচ এই শুভমই সব সময় অভিযোগ করত তুহিনা-ই নাকি দেরি করে আসে। ইদানিং ওর আচরণে এক ধরণের উদাসীনতা লক্ষ্য করছে সে। তবে কী শুভম তুহিনাকে আর পছন্দ করছেনা? তা কী করে সম্ভব? তাই তুহিনা ওকে একটু বাজিয়ে নিতে চেয়েছিল।
ফোনালাপের মাধ্যমে তুহিনা যখন শুভমকে প্রস্তাব দেয়, বয়স তো আমদের কারোর কমছে না বরং সন-তারিখ মিলিয়ে দেখলে দেখবে বিয়ের সময়টা এককদম এগিয়ে গিয়েছে যেন! এবার বিয়েটা সেরে ফেলি, কী বলো?
_____ এই বে-রোজগারে অবস্থায়!
_____ আমি তো বে-রোজগারে নই।
_____ অর্থাৎ স্ত্রীর মানিব্যাগ্টা আমার মানিব্যাগ ভাবতে হবে, তাই না?
_____ ক্ষতি কি! তাতে অমার্জনীয় কোন অপরাধ তো দেখছি না।
_____ লোকে বলবে স্ত্রৈণ্য।
_____ লোকের ভাবাতে কি যায় আসে!
_____ জীবনটা এত সহজ নয়।
তুহিনা ঘন ঘন ঘড়ি দেখা থেকে বিরত হয়, অসহ্য এই প্রতীক্ষা। আজ একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। এভাবে বেশিদিন চলে না। সম্পর্ককে এভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় না। তাহলে কী একটা ফোন করবে? এখন-ই, এই মুহুর্তে _____ হঠাৎ-ই বাইরের দিকে চোখ যায় তুহিনার, শুভম হন্তদন্ত হয়ে যেন আসছে_____
তুহিনা নিজে নিজেকে প্রশ্ন করে, এই তবে এতক্ষণে শুভমের আসার সময় হয়েছে! একটু আনমনা হয়ে পড়ে সে। এই তো ক’দিন আগে দীঘলীপুখুরির তীরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন একটা ট্যাঙ্কের পাশে বসে দুজনে দেখছিল নৌকা বিহার আর সাত-আট বছরের শিশুদের সাঁতার বা সাঁতার শিখার কৌশল। তখন তো বে-রোজগারের কথাটা আসেনি। গত পরশুদিন ফোনালাপের মাধ্যমে যখন শুভম অযাচীত প্রসঙ্গটা উত্থাপন করল, আজকে তাই এই রেস্তরাঁটায় দেখা করার কথা বলেছিল তুহিনা।
সে দিন দীঘলীপুখুরির তীরে বেঞ্চে বসে চানাচূর চিবোতে চিবোতে শুভম বলেছিল, তুমি কী আজকাল আমাকে পছন্দ করছোনা?
একটু রহস্য করে তুহিনা বলল, মনে করো তাই!
[১]
[২]
_____ আমি তাহলে আত্মঘাতি হবো। এই দীঘলীপুখুরিতে ঝাপ দিয়ে ডুবে মরব।
_____ এতো টিন-এজদের মতো কথা হল।
_____ মৃত্যুর পূর্বে চিরকূটে লিখে যাব, আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী মিস্ তুহিনা রায়।
তুহিনা ভাবে, কার জীবনের দায় কাকে বয়ে বেড়াতে হবে সেটা সময়-ই বলবে মিঃ শুভম চক্রবর্তী।
_____ তোমার কী হয়েছে? হঠাৎ এত পরিবর্তন কেন?
_____ প্রত্যেক মানুষের তো মন বলে একটা কিছু আছে। মান-সম্মানও রয়েছে। এতদিনের সম্পর্কের একটা নাম তো দিতেই হবে।
আজ শুভম এসে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিল দেরি হওয়ার জন্য। কিন্তু সে দিন ফোনালাপে যখন অজুহাত দেখাল ওর বে-রোজগারে অবস্থার কথা জানিয়ে, তুহিনা আর ধৈর্য ধারণ করতে পারেনি বলেই মুখোমুখি একটা হেস্তনেস্তর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে ডেকে পাঠিয়েছে।
তুহিনার কানেই যায়নি যেন ওই দেরি হওয়ার অজুহাত। বরং চিড়িয়াখানার লো[কজনদের যাতায়াত দেখে নিজের অজানতেই যেন চোখের সামনে সব কিছু যাপ্সা! ওর বাবা পাত্র ঠিক করেছেন ওর জন্যে। সেই পাত্র কিন্তু একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তি। বাবা-মা ওদের একমাত্র মেয়ের জন্য গয়না গড়িয়ে রেখেছেন, তিলে তিলে ব্যাঙ্কের একাউন্টে টাকা জমিয়েছেন, আশা করে রয়েছেন মেয়ে ওদের নির্বাচিত পাত্রের গলায় মালা দেবে। সেই পাত্রের রয়েছে অগাধ প্রাচুর্য কিন্তু ক’জন মেয়েবন্ধু রয়েছে তা অবশ্য জানা নেই। তুহিনা সরকারি স্কুলের শিক্ষয়িত্রী অর্থাৎ স্বাবলম্বী মেয়ে, ওর মতামত উপেক্ষা করে মা-বাবা পাত্রপক্ষকে পাকা কথা দিয়ে দিয়েছেন। এই কথা শুভমকে বলা মাত্র ওর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?
আমাদের এই সনাতন ভারতবর্ষে মা-বাবাকে মনের কথা খুলে বলা যায় না। এখনও বাঙালি মেয়েরা লজ্জ্বা-শরমের মাথা খেয়ে ফেলেনি যে মা’কে নিজের প্রেমিকের কথা বলবে! তাই অন্যভাবে ঘুরিয়ে নিয়ে এমন ভাবে কথাটা বলল তুহিনা, তোমাদের ছেড়ে চলে যাব ভাবতেই পারছি না_____
_____ এ যে মেয়েদের ধর্ম। স্বামীর সংসারটাই সব।
_____ আরো কিছুদিন নাহয় যাক্।
_____ এমন ঘর-বর সহজে মেলেনা, তোর ভাগ্য ভাল যে ওরা যেচে এসেছে।
কথা আর বাড়ায়নি তুহিনা। মা’র চোখে-মুখে প্রত্যাশা_____
শুভমকে দেখে তেতে ওঠে তুহিনা, এতক্ষণে সময় হল?
_____ কাজ ছিল।
_____ কী এমন কাজ শুনি?
_____ সব কাজের কথা তো আর বলা যায় না।
তুহিনা আশ্চর্য হয়ে যায় শুভমের কথা শুনে। সম্পর্কের মধ্যে তাহলে লুকোচুরি শুরু হয়ে গেছে। অবিশ্বাসের দানা বাঁধছে! ঘুণপোকা যেভাবে কাঠের ভিতরে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে কাঠ ক্ষয়ে ফেলে, সম্পর্ক কী এই পর্যায়ে?
_____ ঠিক আছে কাজের কথা না-ই বা বললে, কিন্তু আমার একটা জরুরী কথা ছিল, তাই ডেকে পাঠালাম।
[৩]
তুহিনা বলল।
_____ তাড়াতাড়ি বলে ফেল আমাকে এখনই আবার যেতে হবে_____
_____ বসবার সময়ও নেই?
পাশের চেয়ারটা টেনে শুভম বসল বটে, তবে চেহারায় অসহিষ্ণু ভাব।
_____ এবার বল কী কাজ ছিল? তুহিনাও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়।
_____ আমাদের ক্লাবের বার্ষিক অনুষ্ঠানে যাবতীয় দায়ীত্ব আমার কাঁধে বর্তেছে, তোমার তলব পেয়ে তড়িঘড়ি ছুটে এলাম। বলো কী কথা?
_____ খুব জরুরী বিষয় না হলে কি আর একঘণ্টা ধরে এখানে বসে বসে অপেক্ষা করতাম!
_____ আমার জন্য তুমি অপেক্ষা করবে এতো স্বাভাবিক।
_____ আর তুমি?
_____ নিশ্চয়। চা পান করবে?
_____ না। কফি পান করছি দেখছোনা! তারিয়ে তারিয়ে এক কাপ কফি পান করছি যাতে একঘন্টা সময় পার করে নিতে পারি। এখনও কাপের নীচে সামান্য রয়ে গেছে।
তুহিনা হঠাৎ গলার স্বর নরম করে বলে, আমার বিয়ে_____
সম্পূর্ণ বাক্যটা শেষ করতে পারল না তুহিনা, তার আগেই শুভম বলে ওঠে, তোমার বিয়ে! বাহ বেশ তো। দারুণ খবর।
_____ ঠাট্টা নয়, সত্যি।
_____ আমাকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছ। দেখি, দেখি, নিমন্ত্রণ কার্ডটা কোথায়?
_____ ফাজলামি ছাড়ো।
_____ তোমার বিয়ে হচ্ছে, সে তো খুশির খবর। তা সেই ভাগ্যবানটি কে শুনি?
_____ না-ই বা শুনলে! আমরা দু’জনে প্রাপ্তবয়স্ক, আইনত আমরা বিয়ে করতে পারি।
_____ তা হয়তো পারি। কিন্তু হুট করে তো আর বিয়ে করা যায় না। বিয়ে এমন একটা পবিত্র বন্ধন। অভিবাবকদের আশীর্বাদ যেমন প্রয়োজন বা সঠিক সময়ও বেছে নিতে হয়। তাছাড়া আমি বে-রোজগারে।
তুহিনা আগুণ ঝরা কণ্ঠে বলল, তুমিই না একদিন বলেছিলে, আমাকে না পেলে আত্মঘাতি হবে। দীঘলীপুখুরিতে ঝাপ দিয়ে ডুবে মরবে!
শুভম হেসে ওঠে, ও এই ব্যাপার। এটা তো পুরনো কথা।
_____ মানে! তুহিনা জ্বলে ওঠে।
_____ প্রেমের ব্যাপারে ক’জন সফল হতে পারে। কিন্তু তাই বলে তুমি চলে গেলে যে আমি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ব, তোমার শূন্যস্থান অন্য কেউ এসে পূর্ণ করে দেবে_____
[৪]
কথাগুলো বরফ ঠাণ্ডা গলায় বলল শুভম।
_____ শুভম! তুহিনা রুঢ় গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, শেষ পর্যন্ত তুমিও একটা প্রতারক?
_____ কী যা তা বলছো?
_____ ঠিকই বলছি। উন্মাদের মতো চিৎকার দিয়ে তুহিনা বলে ওঠে, চলে যাও_____ চলে যাও_____ আমকে একা থাকতে দাও_____
চারপাশের লোকজন তুহিনা আর শুভমের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
শুভম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, তারপর রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়ে যায়। তুহিনাও উঠে দাঁড়ায়। বাইরে বেরিয়ে এসে শুভমকে আর দেখতে পেল না।
রাস্তায় চলমান জনতার ঘূর্ণীস্রোতের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে শুভম ভাবে, যদিও এভাবে বলাটা উচিত হয়নি, কিন্তু সে নিরুপায়। এটাকে প্রতারণা বলে না বরং একটা অবাঞ্চিত ঘটনা মাত্র। নিজে স্বাবলম্বী নয়, এমতাবস্থায় কোনো দায়িত্বভার নেওয়া অনুচিত। আজ তুহিনা ওর কাছে যে আঘাত পেয়েছে এতে নূতন দিগন্ত খুঁজে পাবে। আবার বিপরীতটাও তো হতে পারে! শুভম আর কিছু ভাবতে পারছেনা। প্রখর রৌদ্রে মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
By Farida Parveen

Comments