Aaina
- Hashtag Kalakar
- Jun 7, 2024
- 5 min read
Updated: Jul 18
By Sanchita Kar
আয়না
পায়েল আর সৌভিকের বিয়ে হওয়ার আগে থেকেই পায়েল জানত সৌভিক যেকোনো অলৌকিক জিনিসের প্রতি ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট হয়। নানা রকম দোকান আর ওয়েবসাইট থেকে ভূতুড়ে জিনিস কিনে জড়ো করে। এই নিয়ে ওদের মধ্যে বেশ কিছুবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। তবুও সৌভিককে দমানো যায়নি। এমনকি মধুচন্দ্রিমাতে গিয়েও সারাদিন এই সব নিয়েই কথা বলে গেছে। সৌভিক পেশায় অঙ্কের প্রফেসর আর পায়েল, রসায়নের। বিজ্ঞান নিয়ে সারাদিন ঘাটাঘাটির পরও যে কি করে সৌভিক এই অলৌকিক জিনিসে বিশ্বাস করে, তা পায়েলের বোধগম্য হয়না। সৌভিক অবশ্য বলে অঙ্ক দিয়েই নাকি একদিন ভূতের অস্তিত্বও প্রমাণ করা যাবে। এই সংগ্রহের বাতিকটা অবশ্য এদের পরিবারের বংশগত। সৌভিক তার বাবা ঠাকুরদাকেও দেখেছে এরকম অদ্ভূত সব জিনিস দিয়ে সংগ্রহশালা ভড়িয়ে তুলতে।
তবে বিপত্তি ঘটা শুরু হলো ওই আয়নাটা আনার পর থেকে। কালচে সোনালি রঙের সাতটা সাপ আয়নাটার চারপাশে পেঁচানো। একটা আরেকটার ওপর জড়িয়ে রয়েছে। সাপগুলোর কালচে দাঁত-ওয়ালা মুখ বাইরের দিকে বের করে হা করা। যেন কাছে গেলেই ছোবল মারবে। দেখেই পায়েলের কেমন গা গুলিয়ে উঠলো। ও এমনিতেই এই সরীসৃপ জাতটাকে মোটে দেখতে পারে না। তার ওপর আয়নাটা পরিষ্কারও না। কাঁচের ওপর জায়গায় জায়গায় রক্তের দাগের মত লাল ছিটে। সোফার ওপরে দেওয়ালের তাকে রাখল সৌভিক ওটাকে। আয়নাটা নাকি কোন এক সাধুর মন্ত্রে তৈরি। ওটার ভেতরে কোনো এক দানবী বা অশরীরী নাকি বন্দী আছে। পায়েল ঠিক করলো, সে একা ওই বসার ঘরে কিছুতেই থাকবে না। বেশিক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে থাকলে ভয় লাগে, মনে হয় যেন ওই অশরীরী বুঝি এই দেখা দেবে কাঁচের পিছনে। কিন্তু সৌভিকের এত উৎসাহ দেখে পায়েলই এবার দমে গেলো। যতই হোক অনেক ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছে। খুব অল্পতেই খুশি হতে শিখতে হয়েছে সৌভিককে। বনেদি পরিবার হওয়ায় টাকা পয়সার অভাব হইনি কখনও ঠিকই কিন্তু কড়া বাবার শাসনে আবেগও তেমন পায়নি।
পরদিন সকালে দুধ জাল দিতে গিয়ে সেটা যখন কেটে ছানা হয়ে গেল, পায়েল বিরক্ত হয়ে একটা বাটার টোস্ট খেয়েই ইউনিভার্সিটির উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে গেল। সৌভিক আর ও একসাথেই গাড়ি করে কাজে যায়, সেদিনও তাই-ই গেল। তার পরদিনও ঘটলো একই ঘটনা। হুড়মুড় করে সকাল বেলা নতুন দুধের প্যাকেট এনেও তৃতীয়বার একই কান্ড ঘটার পর পায়েল একটু ভয়ই পেয়ে গেলো। আগের দিনের তরকারিটা ফ্রিজ থেকে বের করে দেখে সেটাও পচে গন্ধ বেরোচ্ছে। পুরো বাটিটা ধরে ফেলে দিতে হল। কোথাও একটা ওর ধারনা হলো যে ওই অভিশপ্ত আয়নাটার জন্যই এসব ঘটছে। অল্প রাগ দেখিয়ে সৌভিককে বললো, “তুমি ওই আপদ আয়নাটাকে দুর করবে প্লিজ? ওইটা আনার পর থেকে যত সব আজগুবি কান্ড ঘটা শুরু হয়েছে বাড়িতে। কোথা থেকে আনো বলতো এইসব অলক্ষুণে জিনিস? বাড়িতে কি আয়নার অভাব ছিল না অভিশপ্ত জিনিসের অভাব ছিল যে ওইটা কিনলে আবার?” সৌভিক শান্তভাবে বউকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে গরমে তো খাবার বা দুধ নষ্ট হয়েই। এতে তো অলৌকিক কিছু না ও থাকতে পারে। পায়েল সেই যুক্তিতে একটু ভরসা পেলো বটে তবুও মনের দ্বন্দ্বটা পুরোপুরি গেলো না।
এরপর দুদিন আর কিছু ঘটলোনা তবে তৃতীয় দিনে বাড়ির সদর দরজাটা খুলেই পায়েল চিৎকার করে উঠলো। সৌভিক ছুটে এসে দেখে দরজার বাইরে দুটো মরা কাক পরে আছে। তাদের ছিন্ন ভিন্ন দেহের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিড়ালের নিষ্ঠুর খেলার শিকার হয়েছে অবলা পাখি দুটো। সকাল সকাল এইরকম একটা ঘটনা দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল দুজনেরই। সেদিন পায়েলের আর ইউনিভার্সিটি যেতে ইচ্ছে করলো না বলে সে ছুটি নিয়ে একটু মা বাবার কাছে গেলো। বিকেলে ফেরার পথে সৌভিক তাকে গাড়ি করে নিয়ে এলো। দিনটা ছিল বুধবার। পায়েলের মন মেজাজ ভালো ছিল না। রাতে খেতে বসেও তেমন একটা কথা হলো না দুজনের মধ্যে। একটা চাপা অস্বস্তি যেনো পায়েলকে চেপে ধরছে। সৌভিকও থেকে থেকে এক-দুবার তাকালো আয়নাটার দিকে। আয়না যেমন ছিল তেমনই রইল। তবুও রাতে শুয়ে শুয়ে একবার ভাবলো, সত্যিই আয়নাটার জন্যই সব হচ্ছে না তো? পরক্ষনেই ভুল ভাবছে ভেবে সে চিন্তা মাথা থেকে দূর করার চেষ্টা করল। তবে এরপর যা ঘটলো তাতে দুর্ভাবনাটা আবার ফিরতে বাধ্য হলো।
বৃহস্পতিবার ইউনিভার্সিটিতে টিচার্স রুমে সেনগুপ্ত স্যারের সাথে কথা বলতে বলতে ছাত্রদের খাতার স্তূপ রাখতে গিয়ে লোহার বড় আলমারিটা টাল খেয়ে সৌভিকের গায়ে পড়ে গেল। বাকি শিক্ষকরা দৌড়ে গিয়ে আলমারিটা ধরাধরি করে সরালো তবে ততক্ষণে সৌভিক বেশ কিছুটা আহত হয়েছে। হেড স্যার-ই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। পায়েলও সঙ্গে গেল। ডাক্তার দেখে বললেন কোনো হাড় ভাঙেনি তবে বা হাতের কব্জিটা মচকেছে আর বা কাঁধটায় কালশিটে পড়ে গেছে, কোমরেও লেগেছে ভালই। কপালেও একটু কেটে গেছে। লোহার জিনিসে কেটেছে বলে অ্যান্টি-টিটেনাস ইনজেকশনও নিতে হলো। একগাদা ওষুধ ও সাত দিন টানা বিশ্রামের প্রেসক্রিপশন লিখে ডাক্তার বাড়ি পাঠালেন সৌভিককে। ওকে দেখভাল করার জন্য পায়েলও ছুটির আবেদন পত্র জমা দিল।
তবে সে পত্র অনুমোদন হয়ে আসার আগেই পায়েলের সাথে ঘটে গেলো এক বিপদ। ছোট একটা খেলনা গাড়িতে পা হরকে সিড়ি থেকে পড়ে ডান হাত ভাঙলো সে। পাশের বাড়ির ছোট্ট অয়ন ওদের বাড়িতে আসে মাঝে মাঝে খেলা করতে। সৌভিকের খুব নেওটা সে। সৌভিকও ওকে কোলে মাথায় তুলে, গল্প বলে মাতিয়ে রাখে। কিন্তু সেই খেলাই যে ওদের কাল হবে তা জানলে হয়ত সেদিন ওকে খেলতে আসতে বারণ করতো সৌভিক। দুজনেই আহত হওয়ায় একজন আয়ার ব্যাবস্থা করতে হলো।
একই দিনে দুটো বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সৌভিকও এবার মহা দুশচিন্তায় পড়লো। পায়েল চাপা গলায় বললো, “সৌভিক এবার কিন্তু আমার সত্যিই ভয় করছে। এর আগেও তো এত জিনিস কিনেছো কই তখন তো এরকম বিপদ ঘটেনি। অয়নও তো আর আজকে প্রথমবার খেলনা ফেলে যায়নি। ও তো হামেশাই খেলনা রেখে যায় এ বাড়িতে, পরে এসে খেলবে বলে। প্লিস আমার কথাটা শোনো, ওই আয়নাটা ফেলে দাও। তুমিই তো বলেছিলে ওটায় নাকি কোন এক অশরীরী বন্দী করা আছে। কে বলতে পারে হয়ত তার অভিশাপেই এসব হচ্ছে, এসব ভালো জিনিস না। দয়া করো। বিদায় করো ওটাকে”। কথাটা বলে পায়েল একবার ভয় মিশ্রিত আড় চোখে সোফার ওপরে তাক টার দিকে তাকালো। আয়নার স্থানের পরিবর্তন হয়নি তবে ওর কেনো যেনো মনে হলো সাপ গুলো নিজেদের মধ্যে জায়গা বদল করেছে। সে কথা সৌভিককে বলতেই ও বললো, “তুমি এতো চিন্তা করো না। তবে আমার জন্য তুমি বিপদে পড়লে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না, আয়া মাসিকে বলবো আয়নাটা ভেতরের স্টোর রুমে রেখে দেবে। পরে না হয় ওটার একটা ব্যাবস্থা করবো। সত্যি কথা বলতে আমার যে একটুও ভয় লাগছে না তা নয়, ওই সাপগুলো আমাকেও ভাবায়। তবে একটা মনের ভুলকে প্রশ্রয় দিতে চাইছিনা এই আর কি”।
সেই কথা মত আয়া মাসি আয়নাটাকে কাপড়ে মুড়ে স্টোরে রেখে দিল। তবে দুর্ঘটনা ঘটা বন্ধ হলো না। একটা জানলা চাপ দিয়ে খুলতে গিয়ে সৌভিকের হাতটা ফস করে কেটে গেল। পায়েল ছুটে এসে জানলাটা হালকা টেনে দিতে দিতে সৌভিককে বকা লাগালো, “এই অসুস্থ শরীর নিয়ে তুমি কেনো উঠতে গেলে? ইশ কতটা কেটে গেছে। আমাকে ডাকলেই তো পারতে। এই জানলাটা একটু আটকে যায় জানোই তো। দাড়াও ওষুধ নিয়ে আসি”।
এর মধ্যে রাতে একদিন খেয়ে ওঠার পর সৌভিক সংগ্রহশালা থেকে ফিশ-ফিশ করে কথা বলার আওয়াজ পেল। দরজা খুলে ঢুকতেই সৌভিক দেখে আয়নাটা অন্ধকার ঘরের মেঝেতে রাখা। টর্চ হাতে আয়নাটার কাছে সম্মোহিতের মতো এগিয়ে যেতেই ওর কেমন যেন মনে হলো আয়নাটা থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। আর পাশে একটা কাগজে রক্ত দিয়ে লেখা “শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে”। সে চিৎকার করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। দোতলায় গিয়ে পায়েলকে সব কথা বলতেই সেও ছুটে এলো। ওর চিৎকারে ততক্ষণে আয়া মাসিও এসে গেছে। সৌভিক তো ঘরে ঢুকে অবাক। কোথায় কি? কাগজ, ধোঁয়া কিছুই নেই। সৌভিক হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ তারপর মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো। সারা রাত ঘুমাতেও পারলো না। থেকে থেকেই যেন সৌভিক ফিশফিশ করে কারোর গলা পাচ্ছিল। যেন ওকে কেউ ডাকছে। বার বার বলছে ওর শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে। পায়েল অবশ্য কিছুই শুনতে পেল না। আওয়াজটা কি সত্যিই হচ্ছে নাকি স্রেফ ওর মনের ভুল? কিছুই ঠাওর করতে পারলো না।
পায়েল সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে ওরা আর একদিনও এইখানে থাকবে না। সৌভিকও আপত্তি করল না। এই ঘটনায় মানসিক ভাবে খুবই ভেঙে পড়েছে সে। এইসব শুনে পায়েলের মা বললেন, “তোরা একটা পুজো দে। এসব কিন্তু ভালো লক্ষণ না। আর ওই আয়নাটাকেও ফেলে দে”।
পরদিন সকালে ওরা ক্যাব বুক করলো পায়েলের বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় যেতে যেতেই সৌভিকের মাথায় কথাটা এলো, “আচ্ছা পায়েল, তোমার মনে হয়না এই ঘটনাগুলো একটু বেশীই অস্বাভাবিক আর কাকতালীয়? মানে এর আগে তো কতই জিনিস কিনেছি কিন্তু জানো সেদিন যখন আয়নাটার ডেলিভারি এলো, তখন দিপেশ মণ্ডলের সাথে দেখা”। “মানে ওই মন্ডল প্রোমোটার এর মলিক? সে কি আবার বিরক্ত করা শুরু করেছে নাকি?” “না তেমন কিছু না, যেদিন আলমারির কেসটা হলো, সেদিনও ইউনিভার্সিটির বাইরে ওকে দেখলাম। আর তারপর কাল লেটার বক্সে এটা পেলাম”, বলে সৌভিক একটা চিরকুট এগিয়ে দিল। তাতে লেখা – তোর শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে। “তাই ভাবছিলাম যে কোনোভাবে এর সাথে ও যুক্ত নেই তো? মানে বাড়ি আদায় করার জন্যে তো ওরা এরকম ভয়-টয় দেখায় শুনেছি”। পায়েলও চিন্তিত মুখে কাগজটার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়লো। ব্যাপারটা সুবিধের ঠেকছে না। শিগগিরই কিছু একটা ব্যাবস্থা নিতে হবে।
ওদের বাড়িটা শহরের নিচের দিকে। ক্যাব চালক গাড়িটাকে ঢালু রাস্তাটার ওপর দিকে দার করিয়ে ওদের জিনিসপত্র গুলো নামাতে লাগলো। পায়েলের অনুরোধে সে ভেতরে গেলো সুটকেসগুলো রেখে আসতে। সৌভিক তখন গেটের বাইরেই দাড়িয়ে ফোনে অনলাইন পেয়েমেন্ট করার অ্যাপটা খুলছিল। পরক্ষনেই কোথা থেকে একটা ছেলে ফুটবল খেলতে খেলতে গাড়িটাতে এসে ধাক্কা মারলো আর গাড়িটাও ঠিকমতো ব্রেক না হওয়ায়, ঢাল বেয়ে সজোরে সৌভিকের দিকে এগিয়ে এলো। ফোন থেকে মুখ তুলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ একটা জোড়ে ধাক্কা অনুভব করলো সৌভিক, বুকের ওপর একটা অস্বাভাবিক ব্যাথা আর মরমর শব্দে চারদিকটা অন্ধকার হয়ে গেলো। শেষ বারের মত দুর থেকে একটা চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এলো।
সৌভিকদের বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে কিছু মাস আগে। মন্ডল প্রোমোটারসরা সেখানে পাঁচ তলা অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করেছে। পায়েল এখন সেইখানে ওর ভাগে পাওয়া তিন কামরার ফ্ল্যাটে থাকে। আজ এক বছর হলো সৌভিক নেই। খুব মনে পড়ে ওর কথা। ওর হাসি মুখের ছবিতে মালা পড়ানো। বড্ড ভালো আর সাধাসিধে ছেলে ছিল সৌভিকটা। নিজের অঙ্ক আর অলৌকিক জিনিসের সমাহার নিয়েই ছিল তার ছোট্ট জগৎ। দুনিয়ার মার প্যাঁচ অতো বুঝতো না ছেলেটা। পায়েলকেও খুব বিশ্বাস করত ও, তাই জন্যই তো ওকে মানিপুলেট করা এত সহজ হলো।
By Sanchita Kar

Comments