পাগলী
- Hashtag Kalakar
- Oct 11
- 4 min read
By Farida Parveen
গ্রামের মেয়ে নয়না। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে করে সে দিশেহারা। বিধবা মা আর ঘুড়ি-লাঠাই’র সঙ্গে তুলনা করা যায়, এমন আরও চারটে বোন নিয়ে সংসার। ওর বাবার বিষয়-আশয় ছিলনা কোনও দিনই। নিত্যি আনতেন নিত্যি খেতেন, ব্যস। প্রদীপের শেষ আলোটুকুও নিভে গেল যেদিন, সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে নয়নার_____
সন্ধ্যার আলো নিভে যেতেই বাজারের থলে নিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মতো ঘরে ঢুকলেন নিবারণ। আলু-পটল-লাউ-ঢেঁড়স_____ কত রকম সব্জি নিয়ে যে ঘরে ফিরলেন। এরকম কখনও হয় না। এত সব্জি একসঙ্গে নিয়ে আসেননা। সে সঙ্গতিও নেই। দৈনিক পাঁচশত টাকা রোজগারে সাতজনের চলাই কঠিন। তাও প্রতিদিন কাজ মিলেনা। তবুও সপ্তাহ-মাস চালিয়ে নিতে হয় এভাবেই। সারা বছর মাংসের গন্ধই পায়না ওরা, ব্যতিক্রম শুধু নববর্ষ। তিনমাস অন্তর মাছের চোখ দেখে নয়নারা আহ্লাদে আটখানা হয়। কিন্তু হঠাৎ আলু-পটলের সমারোহ দেখে প্রত্যেকেরই চক্ষু স্থির।
নয়না কোমরে আঁচল কষে উনুনে আঁচ দিতে থাকে। সুপ্রভা সব্জি কুটছেন। বাকিরা ঢুলুঢুলু নেত্রে মা-বোনের দিকে তাকিয়েই রয়েছে। সাধ্যাতীত ঘুমকে ওরা বিতাড়িত করার চেষ্টা করছে।
নিবারণ বাঁশের মাচায় পা দুলিয়ে বসে থেকে হঠাৎ করে বলে ওঠেন, নয়না, আমাকে এক গেলাস জল দেয় তো_____ কণ্ঠস্বর কেমন কাঁপাকাঁপা শোনায়।
নয়না মাটির কলসি থেকে জল গড়িয়ে এনে দিয়ে বলে, নাও। খুব গরম পড়েছে তো_____ জল বেশ ঠাণ্ডাই আছে। ধরো_____
জলের গেলাস হাতে নিতে গিয়ে পড়ে গেল। নিবারণের হাত কাঁপছে!
নয়না চিৎকার করে ওঠে, মা দেখো, বাবা যেন কেমন করছেন!
সুপ্রভা তড়িঘড়ি উঠে এসে নয়নার সাহায্য নিয়ে মাচায় পাতা বিছানায় শুইয়ে দিলেন। বলেন, মনে হচ্ছে সর্দিগর্মি লেগেছে_____
আসলে অসুখটা কি সেটা বোঝার আগেই নিভে গেল প্রদীপটুকুও!
অভাবের সংসারে এরপর নেমে এল অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার।
ঘরের বড় মেয়ে হিসেবে নয়না দায়িত্ব এড়াতে পারেনা। কিন্তু সে কি করতে পারে? পড়াশোনার বহরও নেই তেমন। তবে লাবণ্যে ঢলোঢলো চেহারাখানা। সুদেহিনীও। আড়ালে অনেকেই নিন্দে-মন্দ করে। কিছু কিছু কথা কানে আসে বটে, তাতে আক্ষেপ হয় নয়নার।
সুপ্রভার সম্পর্কিত বোন স্নেহপ্রভা এলেন একদিন, হাসিখুশি বিগলিত চেহারার মহিলা। নয়না দু’একবার দেখেছে মাত্র, তবে এযাবৎ এমুখো হোননি। এমনকি, নিবারণ দাশের মৃত্যুতেও নয়। অকাস্মাৎ এসে উপস্থিত হোন। নয়না ভাবল, হয়তো ওর বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন। আনতেই পারেন! সোমত্ত বোনঝির খবর নিয়েই হয়তো এসেছেন। টাকাকড়ি না থাকলে কি হবে! এমনও তো হয়, বিপত্নীক কোনও ভদ্রলোকের সঙ্গে মন্দিরে মালা বদল করে সিঁথিতে সিদুঁর দিয়ে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণে বিয়ে সম্পন্ন হতে পারে। এদিকে, নিবারণ দাশের মৃত্যুর প্রায় বছর খানেক গড়িয়ে গেল। সুপ্রভা শহরে গিয়ে লোকের বাড়িতে কাজ করে কষ্টেসৃষ্টে সংসার প্রতিপালন করেন।
কিন্তু না। মাসী মা’র কানে কি কথা বললেন যেন! ওর বিয়ের ব্যাপারে নয়, নয়না সেটা বুঝতে পারল। তাহলে ব্যাপারটা কি হতে পারে!
[২]
সুপ্রভা স্নেহপ্রভাকে সমর্থন করে বলেন, গরীবের আবার মান-সন্মান?
স্নেহপ্রভা এবার নয়নার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। চোখেচোখে তাকালেন।
নয়না চেয়ে দেখে স্নেহপ্রভার চোখের মণি দু’টো যেন কেমন ঘোলাটে! কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা ওঁর মতলব কি?
_____ চল, তোকে নিয়ে যেতে এসেছি।
_____ কোথায় যাব?
_____ কোথায় যাবি! আমার বাড়িতে। মাসীর বাড়ি যেতে আপত্তি আছে?
_____ না, না, তা কেন! তবে, মা-বোনদের ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না আমি।
_____ ওদের জন্যই তো যাওয়া। আমায় কাজে সাহায্য করতে তোকে নিয়ে যেতে এসেছি। মাস গেলে কিছু টাকা তোর মা’র হাতে দেব। তুইও খেয়ে-পরে বাঁচবি আর মা-বোনেরাও দুটো খেতে পাবে। কী যাবি না?
_____ যাব। অবশ্যই যাব।
স্নেহপ্রভার সঙ্গে সোৎসাহে চলে যায় নয়না। তবু, মনের মাঝে একটা সন্দেহের আঁচ ছিল। মিথ্যে নয় যে, দুদিন পরই টের পায়। তখন আর করার কিছু ছিলনা।
দু’হাটুর ভাঁজে মুখ চেপে চুপচাপ বসে থাকে নয়না। তেলবিহীন শ্যাম্পূ করা চুল কেমন ঝরঝরে মোলায়েম, বারে বারেই ললাটে এসে দোল খাচ্ছে। দামি শাড়ির ভাঁজে সুগন্ধীর স্পর্শে এক ধরণের নেশাতুর আমেজ_____ সৌজন্যে স্নেহপ্রভার আশীষ। ব্যবসায় পদার্পণ করার প্রাক্ মুহুর্ত_____
একফুট দূরত্বে যে যুবকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর দু’হাত কোমরের দু’দিকে রেখে নয়নাকে দেখেই যাচ্ছে_____ দেখেই যাচ্ছে_____ তারপর অনন্তকাল কেটে যায় যেন! যদিও রাতের হিসেবে তিনশত পয়ষট্টি রাত! কত এল, কত গেল। যুবক থেকে পৌঢ়_____ স্নেহপ্রভার শিকল কেটে অবিরত চেষ্টা করে গেছে নয়না, বেরোবার উপায় নেই। এমনই ব্জ্র আঁটুনি যে নির্মল বায়ু সেবন করার কোনো পথই নেই। নিজেকে ওর বড় ঘেন্না লাগে। স্নেহপ্রভার সামনে কখনও কখনও প্রতিবাদ করে বসে_____ বিনিময়ে জুটে চড়-থাপ্পড়-লাথি। কখনও তাই মাথাটা দু’হাতে চেপে ধরে বোবা দেওয়ালে আঘাত হানে। রক্ত ঝরে আবার শুকোয়ও।
(২)
মেয়েটিকে সবাই পাগল বলে ভাবে। সমস্তদিন শহরের ফুটপাত ধরে ঘুরে বেড়ায় আর রাতের বেলা যেখানে ইচ্ছে শুয়ে পড়ে। অনুগ্রহ করে কেউ কিছু খেতে দিলে খায়, নতুবা উপোষ দেয়। নিজের মনে বিড়বিড় করে কি যেন বলে! কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বকা দেয়, নতুবা মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। বখে যাওয়া বাচ্চারা ঢিল ছুঁড়লে কেঁদে ওঠে নতুবা চিৎকার করে সাত পুরুষ উদ্ধার করে।
বয়স আনুমানিক আঠারো থেকে কুড়ির ভিতর। গাত্রবর্ণ তামাটে, এককালে হয়তো ফর্সাই ছিল। চুলে বহুদিন যাবৎ তেল পড়েনি, দেখলেই বোঝা যায়। শতচ্ছিন্ন দেহাবরণে লজ্জা নিবারণ হয়ে ওঠেনা। তাই দেখে এক মহিলা দয়াপরবশ হয়ে একখানা শাড়ি কিনে ওর শরীরটা ঢেকে দেন। শহরেই মহিলার বাসস্থান। ছাঁদে ওঠে লক্ষ করলে দেখা যায়, গাড়ির দাপট আর মাথা উঁচু সব দালান-বাড়ি। তারই মাঝে একদিন দেখতে পান, অদূরে ফুটপাতে বাসস্থান করে নিয়েছে ওই হতভাগা পাগলী মেয়েটা। কাছে গিয়ে দেখেন, কঙ্কালসার মেয়েটার নাক-মুখ-চোখ কি অপূর্ব দেখতে! বখাটে ছেলে-ছোঁকরারা ওকে দেখে অশ্লীল ইঙ্গিত করে_____ নিজেদের মধ্যে অসভ্য
[৩]
কথাবার্তাও বলাবলি করে। এদের এসব আচরণ দেখে রমলা নিজেই অপমান বোধ করেন। এসব সহ্য করতে না পেরে একদিন একখানা শাড়ি কিনে ওর শরীরটা ঢেকে দিয়ে ঘরে নিয়ে আসেন মেয়েটাকে। কিন্তু সে তো কিছুই বোঝেনা। পরদিন সকালে কাজের মাসী এসে দরজায় বেল দিতেই রমলা দরজা খুলে বলেন, সারারাত মেয়েটি ঘুমোয়নি। খানিকক্ষণ হল ঘুমিয়েছে। ওর ঘুম ভেঙে যাবে বলে তোর দাদা আর সায়নকেও বলেছি শব্দ না করতে_____
_____ কোন মেয়েটাগো বৌদি?
_____ ফুটপাতের ওই পাগলী মেয়েটা।
_____ ওকে আপনি ঘরে নিয়ে এসেছেন? আপনি পারেনও বটে! দাদা কিছু বলেননি?
_____ কি করব! তোর দাদা আমাকে এসব নিয়ে কত বকাঝকা করেন। তবুও_____ তোর কথাই ভেবে দেখ্না, পাঁচটি মেয়ে নিয়ে অথৈ সাগরে ডুবেছিলি, আগের কাজের মাসীকে ছাড়িয়ে তোকে রাখলাম_____
_____ তোমার দয়ার কথা তো আমি জানি। এসব আজকাল কেউ করেনা। চলুন তো দেখি মেয়েটাকে_____
পাগলী মেয়েটা ঘুমিয়ে রয়েছে রান্নাঘরের লাগোয়া বারান্দায়, একটা তক্তাপোষ খালি পড়ে রয়েছে সেখানে, কখনও কখনও বাসন-কোসন ধুয়ে জল ঝরাতে রাখা হয় যেখানটায়_____
কাৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে মেয়েটা।
রমলা কাজের মাসীকে বলেন, সুপ্রভা তুই ওদিকে ঘুরে যা_____ তাহলেই দেখতে পাবে মেয়েটার চমৎকার নাক-মুখ-চোখের গড়ণ।
সুপ্রভা ওদিকে ঘুরে গিয়ে পাগলী মেয়েটার মুখ দেখেই আর্ত-চিৎকার করে ওঠে, নয়না!
রমলা অবাক হয়ে সুপ্রভার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, এ কী তোর সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটা? তোর সম্পর্কিত এক বোন কাজের ওছিলায় নিয়ে গিয়েছিল, ওর কোনো খোঁজ মেলেনি আর!
সুপ্রভা মাথা ঝাঁকায়।
By Farida Parveen

Comments