top of page

চোর

By Farida Parveen


হঠাৎ-ই ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামল। যে যেখানে ছিল মাথা গুঁজতে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিল। আরো অনেকেরই সঙ্গে এক মুদির দোকানের বারান্দার চালার নীচে সিরাজও আশ্রয় নিল। হঠাৎ বৃষ্টি  আসায় ভিজে গিয়ে ওর শীতবোধ হচ্ছে। বারান্দায় জায়গা সঙ্কলান তাই গাদাগাদি ভীড়। ঠেলাঠেলি করে একটু  ভিতরের দিকে জায়গা করে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও সামান্য স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে সিরাজ। দোকানী আর ওর খুদে কর্মচারী তখন খুবই ব্যস্ত। চালায় ফুঁটো হয়ে জল গড়াচ্ছে। চাল-আটার বস্তা স্থানান্তরিত করতে গিয়ে ওরা হিমশিম খাচ্ছে। অসাবধানতা বশঃত হয়তো, ক্যাশবাক্স খোলা পড়ে রয়েছে। সে দিকে ওদের ভ্র ক্ষেপ নেই। এই অবসরে কেউ যদি হাত সাফাই করে ফেলে এই আশঙ্কা সিরাজের মনে দেখা দিল। দোকানী দভদ্রলোকের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। মাথায় এক গাছাও চুল নেই, টাক পড়ে একেবারে চাঁছাছোলা। চোখ যুগল কোঠরাগত। ন্যাঁড়া মাঠে দু’গাছি ধানগাছের মতো চোখের ওপর সাদা ভ্র । নাসা ওষ্ট পর্যন্ত নেমে এসেছে। দুর্বল শরীর তায় অনবরত কাঁশির প্রকোপে নাজেহাল অবস্থা। দোকানীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে এবার দোকানটায় দৃষ্টিপাত করল। না, খুব বড় দোকান নয়। যৎ সামান্য জিনিষপত্র। সিরাজ অনুমান করল জীবন সায়াহ্নে বেচারাকে এত কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে কেন? নিরুপায় নিশ্চয়! হয়তো বা ওঁর ছত্র ছায়ায় পরিবারের প্রতিটি প্রাণী আশ্রিত। একান্ত দূরাবস্থা নাহলে ওঁকে এ বয়সে হাঁড়মাস পিশতে হতো না।  দোকানের আয় উন্নতি তেমন নয়, খুদে কর্মচারিটিকে দেখে অনুমান হয়। তাছাড়া আশেপাশে অসংখ্য দোকান একই রকম, একই জিনিষের। সুতরাং, বৃদ্ধ দোকানীকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হচ্ছে বৈকি!

বৃষ্টি থামার লক্ষণ-ই নেই। অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে।

ক্যাশবাক্স কেউ খোলা রাখে না। অসাবধান বশতঃ বৃদ্ধ দোকানীর ক্যাশবাক্স খোলা পড়ে রয়েছে। হাওয়ার সংস্পর্শে একটা পাঁচশত টাকার নোট তিরতির কাঁপছে। কেউ ওঁকে সাবধান করে দিচ্ছে না তখন সিরাজেরই বা কি এমন গরজ! এমন সময় বাস গাড়ি এসে যাওয়ায় উপস্থিত অনেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে গাড়ি অভিমুখে পা বাড়ায়। এটাই লাষ্ট বাস, অতএব, তৎপর হয়ে সিরাজও বাসের দিকে দ্রুত পা চালায়। বারান্দার ভীড় ঠেলে ওকে এগোতে হয়। আর তখনই পিছন থেকে কলরোল ওঠে চোর, চোর_____

বাসের পাদানীতে পা দিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই সিরাজ হতভম্ব। জনতা ওর দিকে ধেয়ে আসছে। মরিয়া হয়ে সিরাজ ভিতরে ঢুকতে চাইলে কন্ডাক্টর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেশ খানিকটা বাহাদুরি দেখায় যেন!

সিরাজকে টেনে-হ্যাচড়ে পিচরাস্তায় ফেলে যে যেমন পারল হাতের সুখ, পায়ের সুখ মেটায়। এই প্রহার বৃষ্টির মধ্যে সে তবু শুনতে পায়, ভদ্রলোকের আড়ালে ব্যাটা এমন বদমাশ তা কে জানত নইলে বারান্দা থেকে তখনই লাথি মেরে নর্দমায় ফেলে দিতাম

 _____ চোর কোথাকার_____

_____ মারো, আরও মারো।

_____ একেবারে মেরেই ফেলো।

সিরাজ তখন অনুনয়-বিনয় করে বলতে লাগল, দোহাই আমাকে আর মারবেন না, আমি চোর নই।

কে যেন ব্যাঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল, চোর নও, একেবারে সাধু!

_____ পকেট দেখো_____ বলে একজন যুবক দাঁড়ি-গোঁফ-এ আচ্ছাদিত মুখমণ্ডল_____ সে তখন এগিয়ে এসে সিরাজের প্যান্টের পকেট হাতড়াতে লাগল। ওর হাতের আঙুল্গুলো যেন আঙুল নয়, সজারুর কাঁটা। সিরাজ শেষবারের মতো যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। কোনোক্রমে চোখ মেলে দেখল যুবকের ওষ্টে মৃদু হাসির রেখা খেলা করছে।

বৃদ্ধ দোকানী কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, সমস্ত দিনের উপার্জন আমার এই পাঁচশত টাকা। এখন বাড়ি ফিরব কী নিয়ে? মেয়েগুলি যে আমার পথের দিকে চেয়ে থাকবে। ওদের শুকনো মুখ আমি দেখতে পারব না_____ বৃদ্ধ আকূল হয়ে যখন চোখের জল ফেলছিল সিরাজ তখন চোখ সরিয়ে নিল। তখনই দেখতে পায় সে, মাতব্বর গোছের একজন ভদ্রলোক গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, এ চোর ছিঁচকে চোর নয়, একেবারে ঝানু। চোখের নিমেষে পাঁচশত টাকা গিলে ফেলল নাকি! এত প্রহারের পরও যখন টাকা আদায় করা গেল না তখন আমাদের অন্য পন্থা বেছে নিতে হবে।

_____ নিশ্চয়_____ সমস্বরে উপস্থিত জনতা ওকে সমর্থন করল।

_____ তাহলে এই বদমাশ লোকটির হাতের মোবাইল বৃদ্ধের হাতে তুলে দাও।

_____ আমি চোর নই, আমি চোর নই_____ আর্তচিৎকার করে সিরাজ মোবাইলটি অর্থাৎ চলভাষটি রক্ষা করতে চায়। প্রহারের যন্ত্রণায় জ্ঞান হারাতে হারাতেও বুঝতে পারছিল যে চলভাষটি হস্তান্তরিত হচ্ছে।

সিরাজ জ্ঞান হারিয়েই ছিল। জ্ঞান ফিরে আসতে অনুভব করল সমস্ত দেহজুড়ে অসহ্য ব্যথা। হাতে ব্যথা, পায়ে ব্যথা, পিঠে ব্যথা চোয়ালে ব্যথা......। উঠে বসতে চেষ্টা করল। কিন্তু বিফল হল। অনেক চেষ্টার পরে বসতে পারলেও দাঁড়াতে গিয়ে পায়ের পাতা সোজা করতে পারল না। এখন যদিও বৃষ্টি নেই তথাপি আকাশ মেঘে ঢাকা। দেহাবরণ ভিজে জবজবে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় দেহ শিরশির করে কাঁপছে। মনে এত দুঃখ পেয়েছে যে বিড়ম্বিত ভাগ্যের ওপর দেহের ভার ছেড়ে সটান শুয়ে পড়ল। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল, আজ আমি মরব। হ্যাঁ, গাড়ির চাকায় থেৎলে পিশে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাব। দেহের ভার আমি যে আর সহ্য করতে পারছিনা_____ 

একটি গাড়ি এল বটে। এ গাড়ি ওকে পিশে গুড়ো করতে পারবে না। অপমানে কপালে চাপড়ায় সিরাজ, হায় সকলেই আমাকে অপমানে অপমানে_____ অপমানের বোঝা ক্রমে ভারী করে তুলছে। গাড়িটি_____ ঠ্যালা গাড়ি। ঠ্যালা চালক টর্চ জ্বেলে ভাল করে নিরীক্ষণ করে চমকে ওঠে প্রায়, আরে ছোট মিয়া যে!

_____ আমজাদ! তুমি? সিরাজ চমকায়!

_____ এখানে এভাবে রাস্তার মধ্যিখানে পড়ে রয়েছেন যে! কী হয়েছে আপনার?

_____ একটি দ্রুতগামী ট্রাক ধাক্কা দিয়ে ফেলে আমার এই শোচনীয় অবস্থা করে দিয়েছে।

মিথ্যে বলল সিরাজ।

আমজাদ বার কতক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। সিরাজ আরও সংকুচিত হয়ে পড়ে।

_____ চলুন_____ বলে আমজাদ ঝুঁকে ওকে পাঁজা কোলা করে ঠ্যালায় উঠিয়ে শুইয়ে দিল।

সিরাজের পাশের বাড়ির লোক এই ঠ্যালা চালক আমজাদ। চলতে চলতে গভীর অপরাধবোধ ওকে আঁকড়ে ধরে। যদিও সে চুরি করেনি। সহসা সিরাজ আমজাদকে প্রশ্ন করে, এখন রাত ক’টা হবে?

_____ নয়-দশ তো হবেই।

_____ এত রাতে তুমি কোথা থেকে ফিরছো?

_____ আর বলবেন না মিয়াভাই! নাসির মিয়ার পাকা দালান হবে কিনা তাই বালি নিয়ে গিয়েছিলাম। লোকটি এমন বজ্জ্বাৎ, পাঁচ ঠ্যালা বালিতে দিল মাত্র এক হাজার টাকা। তারপর হঠাৎ-ই আমজাদ আদেশের সুরে বলল, আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন মিয়া ভাই। কত কষ্ট হচ্ছে আপনার আর আমি শুধু বক্‌ বক্‌ করাচ্ছি। এতবড় বিপদ থেকে আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করেছেন।

সিরাজ প্রাণপণে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপল। আমজাদের কথা মতো চুপ করে শুয়ে রয়। বাড়ি পৌঁছাবার দায়িত্ব ওর হাতে সপে দিয়ে সে চোখ বুজে নিল। 

[৩]

বাড়িতে প্রবেশ করার মুখে যে বাতিটা, সেটা মিট্‌মিট্‌ করে জ্বলছে। তাই একটা আব্‌ছা অন্ধকার ছেয়ে রয়েছে। আমজাদ হাঁকাহাঁকি করতে লাগল, ভাবী জান? বড় মিয়া ভাই_____ 

খট্‌ করে সিরাজের ভাবী-ই দরজা খুলল। আমজাদ পাঁজাকোলা করে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। ঘরের ভিতর জোরালো আলো। সেই আলোয় দেখতে পেল সিরাজ, ভাবীর মুখাকৃতি অসহ্যরাগে বিকৃত। কিন্তু কেন?

আমজাদ তখন বলতে লাগল, ছোট মিয়া ভাইর ওপর আজ ভয়ানক বিপদ গেছে। ট্রাকের ধাক্কায়_____ 

কথা অর্ধসমাপ্ত রয়। তার আগেই সিরাজের ভাবী ক্রূদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠেন, উচিত শাস্তি হয়েছে।

আমজাদ চমকে ওঠে বলে, মানে_____ মানে_____ 

_____ চুরির ফল। আজ সকালে আমার বালিশের তলা থেকে সাতশত টাকা কে সরিয়েছে? 

সিরাজের ভাবী সিরাজকে চোর সাব্যস্ত করছে। 

মরিয়া হয়ে সিরাজ প্রতিবাদ করল, টাকা আমি নেইনি। আর, যা কিছু চুরি হয়, আমাকে দায়ী করো কেন? কাজের মেয়ে রহিমাও তো ওই টাকা সরাতে পারে। 

_____ রহিমা নয়, তুমিই সরিয়েছ।

উত্তেজনায় সিরাজ উঠে বসল। কঠোর স্বরে বলল, বেকার হতে পারি তাই বলে চোর অপবাদ দিওনা। কখনও চুরি করতে দেখেছ বা শুনেছ?

_____ চোর, চোর_____ একশোবার বলব। গতবছর আমার গলার হার চুরি করে বিক্রি করেছিলে না। দেখি  অস্বীকার করো তো। জুয়েলারটা ভাল থাকায় বরাত জোর পেয়েছিলাম নইলে কি যে হতো ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। তোমাদের তো মুরোদ নেই, আমার বাবা দিয়েছিলেন অত দামী হার। বলছি তাড়াতাড়ি বের করো টাকাগুলি_____ সিরাজের ভাবী পুলিশি তৎপরতা লাগাল। 

জীবনে অজ্ঞানতা বশতঃ এই একটি অপরাধ করে ফেলেছিল সিরাজ। আর কখনও কোনদিন চুরির প্রলোভনে পড়েনি। অভ্যাস বশতঃ প্যাণ্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিতে অনুভব করল ভিজে কাগজের মতো  কি যেন! তৎক্ষণাৎ বের করে এনে দেখল, সেই পাঁচশত টাকা। ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেল। এ কি করে সম্ভব! তৎক্ষণাৎ মনে পড়ল দাঁড়ি-গোঁফওয়ালা যুবকটির ওষ্টময় খেলে যাওয়া মৃদু হাসির উতরোল। ওর কি ক্ষতি করেছিল সে, এমন ভাবে প্রতিশোধ নিল। ওর সাতেও নেই পাঁচেও নেই, তবু কেন পৃথিবী সুদ্ধ লোকের চোখে ওকে চোর সাজালো_____ ভাবতে লাগল সিরাজ, আমি ওর কি করেছিলাম!

আমজাদ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নীরবে সব প্রত্যক্ষ করছিল। সহসা সিরাজের চোখাচোখি হতে প্রচণ্ড ঘৃণায় সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

এতক্ষণ পর অন্য কামরা থেকে সিরাজের বড় ভাই নওয়াজ ওঠে এল। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, পেয়েছ?

সিরাজের ভাবী যেন শুনতে পায়নি। ছো মেরে পাঁচশত টাকা ওর হাত থেকে নিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগল, বাকি দুশো টাকা কোথায়? কোথায় রেখেছ বাকি টাকাটা?

চোর না হয়ে সিরাজ চোর। ওর চোখ দিয়ে জল গড়ায়। তবে লোকের চোখে আজ থেকে সে চোর।   


By Farida Parveen

Recent Posts

See All
Tides Of Tomorrow

By Nishka Chaube With a gasp of air, I break free from the pearly white egg I’ve called home for the last fifty-nine days. Tears spring to my eyes, threatening to fall on the fuzzy crimson sand and in

 
 
 
An Allusion For Anderson

By Aeriel Holman Once upon a time, in the damp cream colored sand, sat two ingénues silhouetted against a hazy sun. The night has not yet risen behind them, and the scene is awash in a pearly gray and

 
 
 
The Castle of Colors

By Aeriel Holman Everyday I wonder, as I glance out the window, Who truly loves me? Who truly cares? There is no pretending for me here. I must be alone. No Knights dressed to shame the moon call to m

 
 
 

Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
bottom of page